বিদেশফেরত প্রবাসীদের আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ

স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করুক মন্ত্রণালয়

করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে, সংকুচিত হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। অবস্থায় বাইরে কর্মরত বিপুলসংখ্যক প্রবাসী কর্মী কাজ হারিয়েছেন। তাদের বড় একটা অংশ দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের অনেকেই কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। আয়-রোজগারহীন অবস্থায় কষ্টে-সৃষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এসব প্রবাসীর পাশে দাঁড়াচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একনেক সভায় বলেছেন, প্রবাসীরা এতদিন অর্থ পাঠিয়ে দেশকে অনেক দিয়েছেন, এবার দেশ তাদের দেবে। তাদের প্রয়োজনে সম্ভব সবকিছু করা হবে। এজন্য একটি প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। এর আওতায় বিদেশফেরত প্রত্যেককেই এককালীন সাড়ে ১৩ হাজার টাকা দেয়া হবে। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নই কাম্য।

তথ্য বলছে, করোনা সংকটে গত এক বছরের বেশি সময়ে বিদেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী ফিরে এসেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে গেলেও সংখ্যাটা খুব অল্প। বেশির ভাগই কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি, দেশে থেকে গেছেন। কাজ নেই। কেউ কেউ সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকের আবার সঞ্চয়ও নেই। সব হারিয়ে এখন ধারদেনায় চলছেন। নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। কেউবা আবার কড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন এনজিও সনাতনী মহাজনদের কাছ থেকে। এক জরিপের ফল বলছে, বিদেশফেরত অভিবাসীদের প্রায় ৬০-৭০ শতাংশেরই আয়ের ব্যবস্থা নেই। জীবিকাহীন। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আর্থিক কারণে তাদের কেউ কেউ সমাজে নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরো কয়েকটি সংস্থার সহায়তায় ব্র্যাকের উদ্যোগে বিদেশফেরত হাজার ২৫০ জন কর্মীকে নগদ অর্থ দেয়া হয়েছিল। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সরকারও ২০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। শতাংশ সুদে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ওই ঋণের অর্থ বিতরণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কাগজপত্র-সংক্রান্ত জটিলতা নানা শর্তের বেড়াজালে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। সে হিসাবে রাষ্ট্রীয় তরফে  বিদেশফেরতদের জন্য এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ তেমন কোনো সহায়তা দেয়া হয়নি। এবার তাদের এককালীন আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি অন্য সমর্থনমূলক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এটা ইতিবাচক সময়োপযোগী। আগের অভিজ্ঞতা ত্রুটি আমলে নিয়ে এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অনেক প্রবাসী শ্রমিকও কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। দেশগুলোর সরকার শুরু থেকেই তাদের সহায়তা করেছে। সুষ্ঠুভাবে তালিকা তৈরি করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ রেশনের ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে অভ্যন্তরে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পুনরায় বাইরে কর্মনিয়োজনে সচেষ্ট হয়েছে। কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করেছে। সংকটে রাষ্ট্র পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্য দেশগুলোর নীতি কৌশল আমাদের জন্য সহায়ক হবে বৈকি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্থিক সহায়তা প্রকৃত সুফলভোগীর কাছে পৌঁছানোর অন্যতম পূর্বশর্ত সঠিকভাবে তালিকা প্রস্তুত। এটি জটিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে অন্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় প্রবাসীদের তালিকা তৈরি করা তুলনামূলক সহজ। কেননা বিদেশ থেকে প্রবাসীরা ফেরত এলে তাদের একটি রেজিস্ট্রি করা হয়। এর ভিত্তিতে সহজেই সুফলভোগী চিহ্নিত করা যায়। কাজেই তালিকা তৈরিতে খুব একটা বেগ পোহাতে হবে না। পারিবারিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সুফলভোগীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং সহায়তা পৌঁছে দেয়া যাবে। বলা হচ্ছে, অনুমোদিত প্রকল্পের আওতায় দুই লাখ প্রবাসীকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। এটি বাস্তবায়ন হবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে প্রবাসী অধ্যুষিত হিসেবে বিবেচিত জেলাগুলোর অভিবাসীরা প্রাধান্য পাবে। ধাপে ধাপে বাকিদেরও এর আওতায় আনার খবর মিলছে। এর আগে বিভিন্ন সহায়তার ক্ষেত্রে তালিকা প্রস্তুতে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে অনেক প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তও সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ নিজ আত্মীয়-স্বজন কিংবা তাদের অনুগত লোকজনদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করার খবরও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ধরনের অনিয়ম এড়াতে প্রবাসী সুফলভোগীদের তালিকা তৈরিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। কর্মী বাছাইয়ে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠনের কথা বলা হচ্ছে। সঠিকভাবে সুফলভোগীর তালিকা প্রস্তুত করা গেলে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হবে না।

শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, বিদেশফেরত কর্মীদের প্রশিক্ষণও দেয়া হবে। প্রশিক্ষণ শেষে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের সনদের ব্যবস্থা করে দেশে-বিদেশে চাকরি পেতে সহযোগিতা করা হবে। অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কর্মীদের আর্থিক, কারিগরি অন্যান্য সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ঋণ সহযোগিতা দেয়া হবে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন উৎপাদনশীল কার্যক্রম ছোট ব্যবসায় উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করারও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা রয়েছে। যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এর সুফল হবে বহুমাত্রিক।

প্রবাসীরা দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। পরিশ্রমলব্ধ অর্থ পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে রাষ্ট্রীয় সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা নানাভাবে অবহেলিত। তারা কেবলই দিয়ে গেছেন, তুলনায় পেয়েছেন কম। করোনা সংকটে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীরা আর্থিক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। জরুরি মুহূর্তে তাদের সমর্থন দেয়া যায়নি। ফলে ভুগছেন তারা। তাদের দুর্ভোগ লাঘবের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এখন পর্যন্ত প্রবাসীদের নিয়ে কোনো সমৃদ্ধ ডাটাবেজ তৈরি করা হয়নি। গৃহীত প্রকল্পের আওতায় একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা হবে বলা হচ্ছে। অনেক দেরিতে হলেও পদক্ষেপ ইতিবাচক। ডাটাবেজের ভিত্তিতে সহজেই যেকোনো সংকটের সময় তাদের সহায়তা দেয়া সম্ভব হবে। যথার্থভাবেই প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তাদের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সর্বতোভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে নেয়া প্রকল্পটি একটি শুভ সূচনা বৈকি। প্রবাসী মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবার ঐকান্তিকতায় এর যথাযথ বাস্তবায়ন হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন