সৌদি-আমিরাত মধুর সম্পর্কে ভাঙনের সুর

বণিক বার্তা ডেস্ক

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আবুধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ছবি: রয়টার্স

চলতি মাসের শুরুর দিককার কথা। জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের এক বৈঠক আয়োজন করা হয়। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল জোটের সম্মিলিত জ্বালানি তেল উত্তোলনে সীমা আরোপ। মধ্যপ্রাচ্যের দুই বড় উত্তোলক দেশ সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যকার দ্বিমতের কারণে শেষ পর্যন্ত বৈঠক ভণ্ডুল হয়ে যায়। সামান্য মতবিরোধ বিবেচনায় বিষয়টি শুরুতে তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। তবে দুই দেশের দুই জ্বালানিমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে জনসম্মুখে বক্তব্য দেয়া শুরু করতেই নড়েচড়ে বসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে বিশ্লেষণে বসেন আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

সৌদি আরব ইউএইর মধ্যকার মিত্রতা দীর্ঘদিনের। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি বর্তমান আকার নেয়ার ক্ষেত্রে রিয়াদ আবুধাবির বন্ধুত্ব অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। আঞ্চলিক কৌশলের দিক থেকেও দুই দেশ সবসময় এক পথেই হেঁটেছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ধরা হয় দেশটির অঘোষিত শাসক হিসেবে। অন্যদিকে আবুধাবি আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ইউএইর অঘোষিত শাসক হিসেবে পরিচিত। দুই যুবরাজের মধ্যে আবার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। তাদের ঘনিষ্ঠতা নিয়েও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চর্চা রয়েছে। বলা হয়, আবুধাবির যুবরাজের শিষ্যত্বেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারভিত্তিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ শিখেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। রিয়াদে তার উত্থানে মোহাম্মদ বিন জায়েদের পরোক্ষ ভূমিকাও রয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই দুই যুবরাজকে একযোগে অভিহিত করা হয় এমবিএস (মোহাম্মদ বিন সালমান)-এমবিজেড (মোহাম্মদ বিন জায়েদ) জুটি হিসেবে।

বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেকেই মানতে চাননি সৌদি আরব ইউএইর মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ সম্ভব। অনেকেই বলতে থাকেন, বিরোধ সাময়িক। দুই দেশের সম্পর্ককে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ মিত্রতার সম্পর্ক আখ্যা দিয়ে সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংবাদিক টমাস ফক বলেন, অর্থনৈতিক লক্ষ্য দুই দেশের সম্পর্ককে পরীক্ষায় ফেলে দিলেও তাদের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য এক। দুই দেশের মিত্রতা শুধু শাসকদের মধ্যকার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের ওপর গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর নানা ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক টিকে রয়েছে। উপরন্তু এর মধ্যে একটি বিষয় সবসময়ই উপস্থিত ছিল। সেটি হলো দুই দেশের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য সবসময় একই ছিল।

আল-জাজিরায় প্রকাশিত ওই নিবন্ধের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। তাদের ভাষ্যমতে, সৌদি আরব ইউএইর মধ্যে ভাঙনের সূত্রপাতও ভূরাজনীতিকে কেন্দ্র করেই। দুই বছর আগেই ইয়েমেন যুদ্ধ ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের মন কষাকষির সূচনা হয়। এছাড়া পরবর্তী সময়ে কাতার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক, লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্যের লক্ষণ দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের মধ্যে বিরোধের বীজ দীর্ঘদিন ধরেই অঙ্কুরিত হয়েছে। ওপেকের ভণ্ডুল হয়ে যাওয়া বৈঠক বিষয়টিকে কেবল প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো বেন কাহিলের সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া মন্তব্যে কথারই প্রতিফলন উঠে এসেছে। তার ভাষ্যমতে, বিরোধ অনেকটা বিস্ময়করভাবেই সামনে এসেছে। যদিও মন কষাকষির বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী ছিল।

দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃস্থানীয় দেশ ধরা হয়েছে সৌদি আরব মিসরকে। এর মধ্যে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ হয়ে উঠেছিল আরব বিশ্বের আর্থিক হাব। তবে গত কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যিক পাওয়ারহাউজ হিসেবে ইউএইর উত্থান সমীকরণকে বদলে দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আবুধাবিকে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতমুখর রাজনীতির দর্শকের ভূমিকা থেকে অনেকটাই সরিয়ে এনেছেন মোহাম্মদ বিন জায়েদ। মিসর থেকে শুরু করে লিবিয়া, ইয়েমেনসহ আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংঘাতের প্রতিটি জায়গায়ই ইউএইকে জড়িয়েছেন তিনি। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক আর্থিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে আরব আমিরাতকে আরো প্রভাবশালী করে তুলেছেন। অতীতে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে অনেকটা সৌদি আরবের ছায়াতেই থেকেছে ইউএই। কিন্তু সর্বশেষ ওপেক প্লাস বৈঠকের ঘটনাটি পরিষ্কার করে দিয়েছে দেশটি এখন আর সৌদি আরবের ছায়ায় থাকতে চাচ্ছে না। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে রিয়াদও।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের স্থানীয় রাজনীতিতে সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন আবুধাবির যুবরাজের দেখানো পথ ধরেই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আবুধাবির ক্রমবর্ধমান প্রভাব বর্তমানে সৌদি শাসক পরিবারের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সৌদি রাজপরিবারে আমিরাতবিরোধী ক্ষোভের মাত্রা বাড়ছে। সামনের দিনগুলোয় দুই দেশের সম্পর্কে আরো অবনতি দেখা যাবে।

ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের দমনে ২০১৫ সালে এক আরব সামরিক জোট গড়ে তোলে সৌদি আরব ইউএই। কিন্তু দুই বছর আগে ইয়েমেন থেকে নিজেদের অধিকাংশ সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় আবুধাবি। বিষয়টি ক্ষুব্ধ করে তোলে রিয়াদকে।

তবে অধিকাংশ সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও ইয়েমেনের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানগুলোয় ইউএইর দখলই বজায় থাকে। ইয়েমেনের সীমান্ত এলাকা এবং সোকোরতা বাব এল মানদেবের মতো দ্বীপ এলাকাগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখনো ইউএইর হাতে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এসব এলাকা হাতে না থাকায় ইয়েমেনে কার্যত সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণ এখন তেমন একটা নেই।

এডেন উপসাগরের দ্বীপ সোকোরতা লোহিত সাগরের দ্বীপ বাব এল মানদেব দখলে থাকায় আফ্রিকা আরব উপদ্বীপের মধ্যকার নৌবাণিজ্য পথের ওপর ইউএইর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু সৌদি আরবের জন্য গোটা ইয়েমেন যুদ্ধই হয়ে উঠেছে গলার কাঁটার মতো।

কুয়েতভিত্তিক এক কূটনৈতিক সূত্র প্রসঙ্গে ইস্তানবুলভিত্তিক টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, সৌদি আরব এখনো ইয়েমেন থেকে বেরিয়ে আসছে না শুধু আত্মসম্মানের কারণে। তারা এখন চাইলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অন্যদিকে ইউএই এরই মধ্যে লোহিত সাগরের প্রতিটি প্রবেশমুখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তারা এর দখল হাতে পেয়েছে শুধু জিবুতি বাব আল মানদেবে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে।

কাতার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক বুলেন্ত আরাসও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পেছনে বড় প্রভাবক হিসেবে দেখছেন। তার মতে, বাইডেন প্রশাসন ইয়েমেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনার পর সৌদি-ইউএই জোট বড় এক পৃষ্ঠপোষককে হারায়। একই সঙ্গে নানা ঘটনাপ্রবাহে দুই দেশের মধ্যকার বিশ্বাসের সম্পর্কে চিড় ধরে দিন দিন তা বড় হতে থাকে।

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ইউএই নিয়ে সৌদি আরবের অস্বস্তির আরেকটি বড় কারণ হলো পশ্চিমা বিশ্বে আবুধাবির ক্রমবর্ধমান প্রভাব। রিয়াদ মনে করছে, পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউএইর সম্পর্ক এখন রিয়াদের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গিয়ে ইউএই মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের কার্যক্রমের ওপর এখন সৌদি আরবের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে রিয়াদ এখন তুরস্ক কাতারের সঙ্গেও সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রয়াস চালাচ্ছে, যা ইউএই সহজভাবে নিতে পারছে না।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাবে সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস নিলেও বর্তমানে পরিস্থিতি উল্টো। তেল আবিবের প্রতি বর্তমানে বিরূপ হয়ে উঠেছে রিয়াদ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, বর্তমানে ইসরায়েলি বেসামরিক উড়োজাহাজও নিজ বায়ুসীমায় প্রবেশ করতে দিতে রাজি নয় সৌদি আরব। অন্যদিকে ইউএই এখন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। বিষয়ও উভয় দেশের সম্পর্ককে আরো তিক্ত করে তুলছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন