অভিমত

করোনায় মৃতের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়: কেন ও কীভাবে?

মেজবাহুল আহমদ, মনির উদ্দিন আহমেদ

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে ঠিক কত মৃত্যু হয়েছে, তার কোনো সঠিক পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে পর্যন্ত ৪০ লাখের অধিক লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি, যা প্রায় ৭০ লাখের কাছাকাছি। অদ্যাবধি বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। যদিও এটি একটি সরকারি পরিসংখ্যান, তবুও গণনা পদ্ধতি এবং এর উপযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাস-সদৃশ মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করছে। হিসাব করোনাভাইরাস-সদৃশ মৃত্যু সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দিতে পারে কিন্তু বাস্তবে ধরনের মৃত্যুর হিসাব বা পর্যালোচনার কোনো সরকারি গ্রহণযোগ্যতা নেই। এতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যাটি অজানাই রয়ে যাচ্ছে।

নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সঠিক গণনা শুধু এক সাধারণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নয়, আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব এখন দৃশ্যমান। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশের বেশির ভাগ উন্নয়ন কার্যক্রম বৈদেশিক ঋণ প্রকল্প সহায়তায় পরিচালিত হয়। মৃত্যুর সঠিক হিসাব না রাখা বা সঠিক হিসাব না থাকার ফলে তথ্যের যে বিভ্রাট তৈরি হয়, তা করোনা অতিমারী নিয়ন্ত্রণে অতি জরুরি টিকার প্রাপ্যতা কমিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে কোভ্যাক্সের বিনা মূল্যের বেশকিছু টিকা পেয়েছে এবং আরো পাওয়ার কথা আছে। যেহেতু টিকার উৎপাদন এর প্রাপ্যতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে, আমাদের ব্যাপারে আরো ছক কষে পদক্ষেপ নিতে হবে। টিকা ক্রয় এবং টিকা কূটনীতিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অব্যবস্থাপনা নজিরবিহীনভাবে গুরুতর এবং অচিরেই যে তা কেটে যাবে তা জোর দিয়ে বলা যায় না। টিকা কূটনীতিতে সফল হতে হলে আগামী দু-তিন বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কূটকৌশলের সংমিশ্রণ এবং ধারাবাহিকভাবে এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় জটিলতা এবং সাম্প্রতিক আমলা-রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত দূর করতে একটি স্বতন্ত্র করোনাভাইরাস মন্ত্রণালয় গঠন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে।

দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সেবা সংস্থাগুলো করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অধিকাংশই বিদেশী সাহায্য-সহযোগিতার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। উন্নয়ন সহযোগীদের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র বৈদেশিক সাহায্য নীতির কারণে বৈদেশিক সাহায্যও দিন দিন কমে যাচ্ছে। অবস্থায় ভুল গণনার কারণে কম করোনা মৃত্যুহার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাকে আরো কঠিন করে তুলবে। নিঃসন্দেহে তা বেসরকারি সেবা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য করবে। জনস্বাস্থ্যে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ।

করোনাভাইরাসে মৃত্যু কীভাবে নিরূপণ করা যাবে? ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সাধারণ গাইডলাইন আছে। সেখানে করোনাভাইরাসে নিশ্চিত এবং করোনাভাইরাস-সদৃশ অসুস্থতা/সম্ভাব্য দুই ধরনের মৃত্যুকেই গণনা করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রথমত, যেসব মৃত্যু সরাসরি করোনাভাইরাসের কারণে হয়েছে, সেসব নিশ্চিত মৃত্যু হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, করোনাভাইরাস-সদৃশ কিন্তু সরাসরি করোনাভাইরাসের কারণে নয়, এমন মৃত্যুকে করোনাভাইরাস-সদৃশ অসুস্থতা/সম্ভাব্য বলে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সেসব রোগী আগে থেকেই বিভিন্ন শ্বাসতন্ত্রজনিত (যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা) বা নানা কারণে অসুস্থ, তাদের মৃত্যুকে সম্ভাব্য হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আবার অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন, কিন্তু পরবর্তীকালে করোনাভাইরাস-প্রসূত নানা শারীরিক জটিলতার কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। ধরনের মৃত্যুর হারও ক্ষেত্রবিশেষে নেহাত কম নয়। তাই করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে উল্লিখিত সব ধরনের মৃত্যুকেই গণনায় নিতে হবে। সরকারি হাসপাতালের করোনা রোগীর মৃত্যু সংখ্যা সহজেই হিসাব করা যায়। এর বাইরে বাড়িতে বা বেসরকারি ক্লিনিকে মৃত্যুর হিসাব রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে সিটিজেন সায়েন্স বা নাগরিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধরনের মৃত্যুর তথ্য সহজেই সংগ্রহ করা যেতে পারে।

২০২০ সালের শেষে এবং ২০২১ সালের শুরুর দিকে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনাভাইরাসে মৃত্যুর রিপোর্টিং সংক্রান্ত গাইডলাইন পরিমার্জন বা সংশোধন করেছে। একই সঙ্গে করোনাভাইরাসে নিশ্চিত এবং করোনাভাইরাস-সদৃশ অসুস্থতা/সম্ভাব্য মৃত্যুর পরিসংখ্যানও হালনাগাদ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে বাংলাদেশের করোনাভাইরাসে মৃত্যুর রিপোর্টিং গাইডলাইন সংশোধন করা জরুরি। ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে হালনাগাদকৃত তথ্য স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক গবেষকদের তথ্যভিত্তিক অতিমারীর পূর্বাভাস গবেষণায়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং প্রশমনবিষয়ক নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

. মেজবাহুল আহমদ: পোস্টডক্টরাল গবেষক

ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা-লিংকন, যুক্তরাষ্ট্র

মনির উদ্দিন আহমেদ: সহকারী অধ্যাপক

শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন