ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা কার্যক্রম শুরু ৭ আগস্ট

কোল্ড চেইনসহ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের বিস্তার ঘটায় রাজধানী শহরের পাশাপাশি গ্রামে সংক্রমণ মৃত্যু দুটোই বেড়েছে। আরো শঙ্কার বিষয় হলো দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা সংক্রমিত রোগীদের ৫০ শতাংশের বেশি গ্রামের। বেশির ভাগ টিকাদান কার্যক্রম শহর জেলাকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামের অনেক মানুষকেই টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে আগামী আগস্ট থেকে দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রম শুরু করার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উপজেলা পর্যায়ে নতুন কর্মসূচির আওতায় শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। গ্রামের সাধারণ সুবিধাবঞ্চিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় পারদর্শী নয়। তাই ইচ্ছা থাকলেও শুধু নিবন্ধন করতে না পারার কারণে অনেকেই টিকা দিতে সক্ষম হয়নি বলেই অনুমেয়। এমন অবস্থায় দেশব্যাপী বিদ্যমান করোনা সংক্রমণের লাগাম টানতে সরকারের উদ্যোগটি সময়োচিত এবং যথাযথ।

করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে এক বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করলেও আমাদের এখনো সুপরিকল্পিত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের অভাব বিদ্যমান। তাই পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে কাজে অগ্রসর হওয়া জরুরি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ত্বরিত সিদ্ধান্ত না নিয়ে স্বল্প মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগোতে হবে। এজন্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণের বিষয়টি বিবেচ্য। সরকারের লকডাউন বাস্তবায়নের সক্ষমতার ঘাটতি আগের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। তাছাড়া লকডাউনে সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই একদিকে যেমন  ভ্যাকসিনেশনের ওপর সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে, পাশাপাশি ভ্যাকসিনের সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখতে হবে। পূর্ববর্তী জটিলতা কেটে বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের পথ ক্রমেই মসৃণ হচ্ছে, যা ইতিবাচক। আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের করোনার ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। সেখানে যখন সংক্রমণ মৃত্যুর হার ক্রমে ঊর্ধ্বে উঠছিল তখন দ্রুত টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে তারা ভাইরাসটির ব্যাপকতা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি প্রতিদিন ছয় লাখের বেশি মানুষকে টিকা দিতে পারে তাহলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসবে। সরকার গত ফেব্রুয়ারি থেকে টিকা দেয়া শুরু করে। মাঝখানে টিকার সরবরাহ সংকটে বেশ কিছুদিন তা বন্ধ থাকলেও আবারো টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন জরুরি। স্বাস্থ্য বিভাগের দক্ষতা কার্যকারিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা আশাপ্রদ নয়। তবে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রচেষ্টায় ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা অসম্ভব নয়।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা বা মুক্তি পেতে মুহূর্তে জরুরি দ্রুত ভ্যাকসিন কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি জোর দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ সংস্থা ডেল্টার সংক্রমণ প্রতিরোধবিষয়ক দিকনির্দেশনা জারি করেছে। যেখানে টিকা নেয়ার পরও মাস্ক পরে চলাচল, সামাজিক বা দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনের কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে বিদ্যমান সংকটের জন্য জন-উদাসীনতা কিংবা অসচেতনতা বহুলাংশে দায়ী। গত বছর ঈদ ঘিরে যাতায়াতের কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। এবারো নানাভাবে ঈদের ছুটিতে মানুষ গ্রামে ফিরেছে। চলমান লকডাউনের মধ্যেও বিভিন্নভাবে মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো মানা হচ্ছে না। চলমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কতদিন অব্যাহত থাকবে তা বলা মুশকিল বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিস্থিতিতে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে ব্যত্যয় ঘটলে পরিণতির ভয়াবহতা বাড়বে বৈকি। জনসচেতনতা বাড়াতে বিশেষজ্ঞরা এখানে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করার কথা বলছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভয়াবহ সংক্রমণ পরিস্থিতি কমিয়ে আনতে সেখানের মেয়র, জনপ্রতিনিধিসহ সবার সমর্থন নিয়ে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়; যা ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে। তাই স্থানীয় সামাজিক সংগঠন, স্থানীয় সরকার, ধর্মীয় নেতা জনপ্রতিনিধি পর্যায়ের সবাইকে নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচি পালন করাটা ফলপ্রসূ হবে।

পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে যে লকডাউন বিধিনিষেধের অর্থনৈতিক ধাক্কাটা পড়েছে দেশের সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। পর্যায়ে সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরালো করতে হবে। টিসিবির কার্যক্রম দেখলে বোঝা যায় মানুষ কীভাবে লাইন ধরে সেখানে আসছে। যদিও সরকার বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক প্যাকেজ নিয়ে কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সরকারের হাতে গরিব জনগণের পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকায় সৃষ্টি হয়েছে সমস্যা। এদিকে করোনার কারণে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে, নতুন করে দরিদ্র হওয়া এসব মানুষও তালিকার বাইরে রয়ে গেছে। সরকার ঘোষণা দেয়ার পরও উপকারভোগীদের কাছে সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। অবস্থায় খোলাবাজারে চাল বিক্রি এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পরিসর বৃদ্ধি করা জরুরি। পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আর্থিক প্রণোদনা কার্যক্রমের ওপরও জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোকেরই বসবাস গ্রামাঞ্চলে। বেশিরভাগ স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় কোল্ড চেইন ব্যবস্থা নেই অথবা থাকলেও দুর্বল। তাই যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি লজিস্টিক সমর্থন কোল্ড চেইন ব্যবস্থার প্রয়োজন এখন। উন্নত দেশগুলো কভিড বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে কোল্ড চেইন ব্যবস্থার পরিধি বাড়িয়েছে। তাছাড়া ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। কাঙ্ক্ষিত কোল্ড চেইন বজায় রাখতে না পারলে ভ্যাকসিন নষ্ট হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে। একটি ভ্যাকসিন একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে, তাই ভ্যাকসিন নষ্ট হওয়ার পরিমাণ সর্বনিম্নে রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অখণ্ড শক্তিশালী কোল্ড চেইন ব্যবস্থা ভ্যাকসিন নষ্টের হার সর্বনিম্নে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচবে, সামাজিক দূরত্বের বিষয়গুলো শিথিল হবে এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করে অর্থনীতিকে মন্দা থেকে পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। তাই কাঙ্ক্ষিত কোল্ড চেইন বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত প্রস্তুতি বাড়ানো দরকার।

করোনায় বাংলাদেশে ঘণ্টায় গড়ে আটজনের মৃত্যু হচ্ছে। পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবার চিহ্নিত দুর্বলতাগুলো দৃশ্যমান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। এখন পর্যন্ত বেশকিছু জেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়নি বলে জানা যায়। এতে উপজেলায় অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা নিশ্চিত করা জটিল হতে পারে। করোনা পরীক্ষা থেকে চিকিৎসাপ্রতিটি ক্ষেত্রে চলমান মহামারীতে বিভিন্ন বৈসাদৃশ্য অব্যবস্থাপনা সাধারণ মানুষের চোখে পড়েছে। টিকাদান ব্যবস্থাপনায় আগের পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। গৃহীত পরিকল্পনা মাঠ পর্যায়ে সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করতে কঠোর তদারকির ব্যবস্থা নিতে হবে। আশার কথা, দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বিস্তারের সুবাদে আমাদের একটি বড় জনবল আছে। রয়েছে গতানুগতিক টিকাদান কর্মী। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এনজিওগুলোরও একটা বিশাল কর্মী বাহিনী বিদ্যমান। তাদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে টিকাদান কর্মসূচি সম্পন্ন হবে, এমনটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন