অভিমত

ইউয়ান লং পিংয়ের প্রয়াণ ও একুশ শতকের খাদ্য চাহিদা

ড. মো. জামিল হাসান

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনে প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গায় হাইব্রিড ধানের চাষ হয়। গণচীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি, যা প্রায় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। হাইব্রিড ধান আবাদের মাধ্যমে এই বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করে চীনারা। পরিসংখ্যানের ভাষায়, বিশ্বের শতাংশের সমপরিমাণ জমি হাইব্রিড ধানের চাষাবাদের আওতায় এনে বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যার দেশ চীন আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বের ১৭টি দেশে বর্তমানে হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণা চাষাবাদ চলছে। হাইব্রিড ধান প্রচলিত উফশী (উচ্চফলনশীল) ধানের চেয়ে শতকরা ১৫-২০ ভাগ বেশি ফলন দিতে সক্ষম। এই জাদুকরী ধানের উদ্ভাবক প্রফেসর ইউয়ান গত ২২ মে ৯১ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে চীনের চাংসা, হুনান প্রদেশে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্মৃতির স্মরণে এই নিবন্ধ।

১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে কেউ ভাবেনি ধানের মতো স্ব-পরাগী ফসলে সংকর সাবল্যকে কাজে লাগিয়ে হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা। প্রফেসর ইউয়ান বিশ্বাস করতেন সংকর সাবল্য একটি সর্বজনীন ব্যাপার, যা ধানের জন্য ব্যতিক্রম নয়। এই অসম্ভবকে আন্তরিক প্রচেষ্টা একাগ্রতা দিয়ে কীভাবে সম্ভব করেছেন, সে গল্প পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।

প্রফেসর ইউয়ান লং পিং ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর বেজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শিশুবেলায় মা হুয়াজিংয়ের কাছে তার ইংরেজিতে হাতেখড়ি। বাবা প্রথমে ছিলেন স্কুলশিক্ষক। পরবর্তী সময়ে রেলওয়ের কর্মকর্তা। শৈশবে তার প্রাথমিক শিক্ষা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের আগ্রাসী ভূমিকা তাকে ভীষণ ব্যথিত করে। ইউয়ান স্কুলজীবনে আনন্দ ভ্রমণে গিয়েছিলেন এক হর্টিকালচার গার্ডেনে। সেখানকার সবুজ ঘাস, তাজা ফুল, লাল পিচ ফল আর থোকা থোকা আঙুর তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। সে সময় আধুনিক সময় (মডার্ন টাইমস) নামে আমেরিকান কমিক ছবি তার কিশোর মনে ভীষণ রেখাপাত করে। কমিক ছবির বিষয়বস্তু ছিল গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যা তাকে কৃষি নিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা জোগায়।

কিশোর ইউয়ান ১৯৪৯ সালে স্কুলজীবন শেষ করে চংচিং রাজ্যের সাউথ ওয়েস্টার্ন এগ্রিকালচার কলেজে কৃষিতত্ত্ব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে হুনান রাজ্যের এনজিয়াং এগ্রিকালচারাল স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি সেখানে উদ্ভিদবিদ্যা, ফসল চাষাবাদ পদ্ধতি, ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিকস পড়ানোর পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষাও পড়াতেন। শিক্ষকতার সূত্র ধরে তিনি ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য মানচুরিয়ান তত্ত্ব অনুযায়ী ফসলের অযৌন সংকরীকরণের ওপর কাজ করেন। তিন বছর গবেষণার পর মানচুরিয়ান তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হলে মেন্ডেলিয়ান প্রজননবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে তিনি স্ব-পরাগী ধান ফসলের জন্য সংকর সাবল্য প্রমাণ করেন। এরই মধ্যে ১৯৬৪ সালে নিজের ছাত্রী ডেনজিকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে দুই সন্তানের জনক হন।

১৯৬৪ সালেই তিনি প্রাকৃতিক হাইব্রিড ধান আবিষ্কার করেন। ১৯৬৬ সালে ইউয়ান প্রথম ধানের পুংবন্ধ্যা বৈশিষ্ট্যের ওপর গবেষণা প্রবন্ধ চাইনিজ সায়েন্স বুলেটিনে প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দেন, যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল পুংবন্ধ্যা বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে ধানের সংকর সাবল্য উদ্ঘাটন করা। এরপর প্রফেসর ইউয়ান ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে হুনান প্রদেশ থেকে ইউনান রাজ্যের হাইনানে যাযাবর পাখির মতো শীত গরমে বিচরণ করতে থাকেন এবং ১৯৭০ সালে হাইনান দ্বীপে Wild Abortive (WA) সাইটোপ্লাজম-সমৃদ্ধ পুংবন্ধ্যা ধান গাছ খুঁজে পান, যা তার হাইব্রিড ধান উদ্ভাবনের কাজ ত্বরান্বিত করে। নয় বছর কঠোর পরিশ্রম করার পর ইউয়ান তার সহযোগীরা তিন সারি পদ্ধতির হাইব্রিড ধান উদ্ভাবনে সক্ষম হন, যার একটি হচ্ছে পুংবন্ধ্যা সারি (A line), একটি উর্বরতা সংরক্ষক সারি (B line) আরেকটি উবর্রতা প্রতিস্থাপক সারি (R line) ১৯৭৪ সালে ইউয়ান ন্যানইউ- নামে একটি হাইব্রিড ধানের জাত বাছাই করেন। ১৯৭৫ সালে হাইব্রিডের বীজ উৎপাদন পদ্ধতি এবং ১৯৭৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের অনুমোদন লাভ করে।

১৯৮৬ সালে তিনি হাইব্রিড ধান উৎপাদন পদ্ধতি আরো সহজ করার জন্য দুই সারি পদ্ধতিতে হাইব্রিড ধান উৎপাদনের কথা বলেন এবং ১৯৯৫ সালে দুই সারি পদ্ধতিতে হাইব্রিড ধান উৎপাদন সাফল্যজনকভাবে উদ্ভাবন করেন, যেখানে একটি সারি কাঁচা থোড় অবস্থায় নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে থাকলে বীজ ধারণ করবে এবং নির্দিষ্ট তাপমাত্রার ওপরে থাকলে পুংবন্ধ্যা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করবে। সারিগুলোকে তিনি থার্মো সেনসেটিভ জেনেটিক মেল স্টেরাইল পরিবেশ সেনসেটিভ জেনেটিক মেল স্টেরাইল বলে আখ্যায়িত করেছেন। দুই সারি পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত হাইব্রিড তিন সারি পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত হাইব্রিডের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ বেশি ফলন দিতে সক্ষম। একুশ শতকের খাদ্য চাহিদার কথা মাথায় রেখে তিনি সুপার হাইব্রিড ধান উদ্ভাবনের রোডম্যাপ তৈরি করেন। যেখানে শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের পাশাপাশি আন্তঃপ্রজাতি সংকরীকরণ এবং আণবিক জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন জিন প্রবেশ করানোর কথা বলা হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রথম ধাপে ২০০০ সালে ১০ দশমিক টন/হে., ২০০৪ সালে দ্বিতীয় ধাপে ১২ টন/হে. এবং ২০১২ সালে তৃতীয় ধাপে ১৩ দশমিক টন/হে. ফলন অর্জনের সাফল্য দেখিয়েছেন। ফলন কোনো গড় ফলন নয়। কোনো একক এলাকায় সর্বোচ্চ ফলন অর্জন সম্ভব হয়েছে। চতুর্থ ধাপে ফলন ১৫ টন/হেক্টরের গবেষণাও সফল হয়েছে, তবে তা একক এলাকার জন্য।

ইরি ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত হাইব্রিড ধান নিয়ে কাজ করলেও সাফল্য আসেনি। ১৯৮০ সালে প্রফেসর ইউয়ান মহামূল্যবান পুংবন্ধ্যা সারি উর্বরতা সংরক্ষক সারিসহ ইরিকে দান করেন। এর পর থেকেই ইরি হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণায় সাফল্য লাভ করে এবং ইরি থেকে একে একে অন্যান্য দেশে হাইব্রিড ধান প্রযুক্তি বিস্তার লাভ করে। একই বছর হাইব্রিড ধান প্রথম এগ্রিকালচারাল পেটেন্ট টেকনোলজি হিসেবে আমেরিকায় স্থানান্তরিত হয়। . ডব্লিউ জুলফিকার ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে আমদানীকৃত হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ শুরু হয়। ব্রি ২০০১ সালে বোরো মৌসুমের জন্য প্রথম দেশীয় হাইব্রিড ব্রি হাইব্রিড ধান১ উদ্ভাবনে সক্ষম হয়। ব্রি পর্যন্ত নিজস্বভাবে সাতটি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে, যার মধ্যে চারটি বোরো, দুটি আমন একটি আউশ মৌসুমের জন্য। দেশে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক নিবন্ধিত হাইব্রিড ধান জাতের সংখ্যা ২০৮টি, যার প্রায় ৮০ শতাংশ চীন থেকে আমদানীকৃত এবং দেশের প্রায় ১০ শতাংশ এলাকা হাইব্রিড ধান চাষের আওতায় রয়েছে। ব্রি প্রফেসর ইউয়ান লং পিংয়ের আদর্শকে ধারণ করে দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় জন্য ইনব্রিডের পাশাপাশি হাইব্রিড ধান নিয়ে আলাদাভাবে নিরলস কাজ করে চলেছে, যা ভবিষ্যতে দেশের টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অমর ধান বিজ্ঞানী প্রফেসর ইউয়ান লং পিংয়ের প্রতিষ্ঠান লংপিং হাইটেক ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রায় ১৫ জন বিজ্ঞানী হাইব্রিড ধানের প্রজনন কৌশল, বীজ উৎপাদন চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর চার মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। ESCAP-এর সহায়তায় লংপিং হাইটেক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের দুজন হাইব্রিড ধান বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ এসে ব্রির ২৫ জন বিজ্ঞানীকে হাইব্রিড ধানের ব্রিডিং, বীজ উৎপাদন, ট্রেতে চারা উৎপাদন পদ্ধতি, চারা ব্যবস্থাপনা, চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে।

ইউয়ান লং পিংয়ের অর্জন এস্টেট প্রমিনেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পুরস্কার, চীন ২০০০ সাল। উলফ প্রাইজ ইন এগ্রিকালচার, ইসরায়েল, ২০০৪। বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, ২০০৪। কনফুসিয়াস শান্তি পুরস্কার, চীন ২০১২। চীনের সর্বোচ্চ পুরস্কার ওডার অব দ্য রিপাবলিক, ২০১৯।

 

. মো. জামিল হাসান: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রধান, হাইব্রিড রাইস বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন