এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোই হোক মূল অগ্রাধিকার

বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের সিডিসি। বিবেচ্য সূচকগুলোয় নির্ধারিত মান পরিপূরণ অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে দেশ। এতে সম্ভাবনার পাশাপাশি বেশকিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে কিছুদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে নানা ফোরামে। সম্প্রতি দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত এক ওয়েবিনারেও এসব বিষয় নিয়ে আলাপ করেন বক্তারা। আলোচ্য ভার্চুয়াল সভায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তারা। এটা করা হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে সুসংহত হবে বলে তাদের মত। এটি আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

চ্যালেঞ্জগুলো এরই মধ্যে স্পষ্ট। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার পর এলডিসি হিসেবে প্রাপ্ত বাণিজ্য সুবিধাগুলো পাবে না বাংলাদেশ। এখন যে রেয়াতি সুদের ঋণ পায়, তা আর পাবে না, উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক সুবিধা, মেধাস্বত্ব সুবিধা ইত্যাদি কমে যাবে কিংবা প্রত্যাহার হবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ আরো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে। বিশেষ করে শুল্ক মেধাস্বত্ব সুবিধা প্রত্যাহারজনিত কারণে দেশের পোশাক ওষুধ শিল্পে বিপুল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কাজেই ধকল মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে বৈকি।

এলডিসি-পরবর্তী উত্তরণের অভিজ্ঞতা অনেক দেশের জন্য সুখকর নয়। দেখা গেছে, নানা কারণে কিছু দেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সমস্যায় পড়েছে। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে, রফতানি, বিদেশী সহায়তা, রেমিট্যান্সও কমেছে। ওইসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বর্তমানে দেশে পণ্য উৎপাদনশীলতা কম, খরচ বেশি। ফলে অন্য দেশ, বিশেষত প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না বাংলাদেশী পণ্যগুলো। তদুপরি পণ্য গন্তব্য উভয় দিক থেকে রফতানি বহুমুখীকরণে ঘাটতি প্রবল। দেশের রফতানি ঝুড়ি এখনো গুটিকয়েক শিল্প পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের রফতানি আয়ের প্রায় ৮২-৮৪ শতাংশই আসে পোশাক শিল্প থেকে। এরপর রয়েছে চামড়া, পাটজাত পণ্য ওষুধ পণ্য। অল্প কতক পণ্যের ওপর অতিনির্ভরতা রফতানি নৈপুণ্য এবং অর্থনৈতিক স্থায়িত্বশীলতা উভয় দিক থেকে দুশ্চিন্তার। বলা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করলে এবং বিদ্যমান সুবিধাগুলো সংকুচিত হলে দেশের রফতানি বাণিজ্য বছরে - বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। তেমনটি হলে পুরো অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ পড়বে বৈকি। তাই রফতানি বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। প্রচলিত পণ্যের বাইরে আরো কিছু, যেমন গ্লাস, সিরামিকস, হালকা প্রকৌশল পণ্য, সিমেন্ট, আইটি পণ্য, কৃষি কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্য, ছোট জাহাজ প্রভৃতির রফতানি সম্ভাবনা রয়েছে। এসব পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণোদনা সমর্থন দেয়া যেতে পারে। শুধু পণ্য নয়, রফতানি গন্তব্যেও বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। জাপান, চীন রাশিয়া, ব্রাজিল, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনায় রফতানি গন্তব্য হতে পারে। রফতানি বাড়াতে ওইসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদারের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা বেশ সহায়ক হবে। প্রতিযোগী দেশগুলো এভাবেই এগোচ্ছে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করা যায়। দেখা যাচ্ছে, পোশাক পণ্যের বাইরে দেশটি ইলেকট্রনিক পণ্য (মোবাইল), যন্ত্রপাতি ইলেকট্রিক্যাল পণ্য, পাদুকা পণ্য এবং কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজ অবস্থান টেকসই করছে। আবার তারা অনেক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য করছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিতেও (আরটিএ) ব্রতী হচ্ছে। কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারতও ধরনের  দ্বিপক্ষীয় বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করছে। ওইসব দেশের নীতি পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশেরও ধরনের কৌশল অবলম্বন জরুরি।

সন্দেহ নেই, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসবে রফতানি ক্ষেত্রে। বড় গন্তব্য ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চাপে পড়বে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি স্থগিত, আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। অবশ্য নিজস্ব পণ্যমানে বাংলাদেশী পোশাক সেখানে জায়গা করে নিয়েছে। আগামী দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আরো পোশাক কিনবে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এটা ইতিবাচক। দেশটির বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তা তেমন একটা নেই। তবে বড় দুশ্চিন্তা হলো ইউরোপীয় বাজার নিয়ে। মোট রফতানির ৫৮ শতাংশ এবং পোশাক রফতানির ৬৪ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। সেখানে রফতানিতে এই দৃঢ় অবস্থান সম্ভব হয়েছে বিদ্যমান ইবিএ (ইভরিথিং বাট আর্মস) ব্যবস্থার কারণে। ইবিএ না থাকলে সেখানে গড়ে - শতাংশ শুল্ক দিতে হবে আমাদের। এটা বড় চ্যালেঞ্জ। নাজুক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি প্লাস নামে একটি কর্মসূচি সামনে এনেছে। এর মাধ্যমে বিশেষ সুবিধায় বাজারে প্রবেশাধিকার দেবে তারা। কাজেই এটি নিশ্চিতে কূটনৈতিক সক্রিয়তা বাড়ানোর পাশাপাশি এর আলোকে প্রয়োজনীয় নীতি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভুটান, লাওস, মিয়ানমার, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ, কিরিবাতি টোভালুর মতো দেশগুলোও এবার এলডিসি উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছে। পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশগুলো কী ধরনের নীতি পরিকল্পনা করছে, সেগুলো অনুসরণপূর্বক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিশ্চয়ই বাজার সুবিধাগুলো চিরদিনের জন্য থাকবে না, আজ হোক কাল প্রত্যাহার হবে। কাজেই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে খরচ কমানো গেলে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়বে। পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বাণিজ্য সহজ করতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থনীতির কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বেগবান করতে হবে। এসব যথাযথভাবে করা গেলে এলডিসি থেকে উত্তরণ কঠিন হবে না, বরং তা সম্ভাবনায় রূপ নেবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন