এসআইজির যাত্রা চার বছর আগে

মূলধন এক কোটিও নয় বিনিয়োগ করতে চায় ২০০ কোটি ডলার

হাছান আদনান

বছর চারেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে নিবন্ধিত হয় সভরেইন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ (এসআইজি) নামের একটি কোম্পানি। ব্যাংকিং আর্থিক সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা কোম্পানিটির মোট মূলধন কোটি ডলারেরও কম। কর্মীসংখ্যাও সাকল্যে ১০ জন। অথচ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কোম্পানিই বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা (ডলারপ্রতি ৮৪.৮০ টাকা হিসাবে) বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশে। দেশের আর্থিক খাতের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় বিদেশী বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি। ঘোষণা এসেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিডি ফাইন্যান্সের মাধ্যমে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির মোট মূলধন ৩০০ কোটি টাকা। আর তাদের মোট সম্পদ দায়ের পরিমাণও হাজার কোটি টাকার কম।

করোনা মহামারীতে সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগে নাজুক পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে দেশের ব্যাংক আর্থিক খাত। বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেই চলতি বছরের এপ্রিলে বিডি ফাইন্যান্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মার্কিন প্রতিষ্ঠান এসআইজি বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ২০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এজন্য বিডি ফাইন্যান্সের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে এসআইজি। ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর ছয় গুণের বেশি বেড়েছে। যদিও মার্কিন প্রতিষ্ঠান এসআইজির ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

এসআইজির গঠন, প্রতিষ্ঠানটির মূলধন সক্ষমতা বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে বণিক বার্তা। দীর্ঘ অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে সন্তোষজনক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এসআইজির ওয়েবসাইটেও সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়া নেই। বাংলাদেশে ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি, প্রতিষ্ঠানটির তহবিলের উৎস বিশ্বের আর কোন দেশে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ আছেসে বিষয়ে জানতে গত ২৯ এপ্রিল এসআইজির ওয়েবসাইটে দেয়া -মেইলে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু সে মেইলের উত্তর পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেয়া টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে এসআইজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ল্যারি নক্স ব্যস্ত আছেন বলে জানান। সুবিধাজনক সময়ে তিনি নিজেই কল করবেন বললেও পরবর্তী সময়ে সে ফোন আর আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকা একাধিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও সভরেইন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ বা এসআইজির বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে জমা দেয়া দুটি প্রতিবেদন থেকে এসআইজির বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মার্কিন পুঁজিবাজার সম্পর্কিত আইনের ৫০৬ (বি) বিধি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য ডি-ফরমে আবেদন দুটি করেছে এসআইজি। কোনো কোম্পানির বিনিয়োগকারী বা শেয়ারধারীদের পরিচয়-সম্পর্কিত তথ্য গোপন রাখার বিষয়ে ওই বিধিতে প্রভিশন দেয়া হয়েছে। এসআইজির জমা দেয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭ সালে তিনজনের উদ্যোগে সভরেইন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ এলএলসি গঠিত হয়। সীমিত দায়ের (লিমিটেড) কোম্পানির ঠিকানা দেয়া হয়, ইলিনয় রাজ্যের শিকাগো শহরের ৫৫- জ্যাকসন বিএলভিডি। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, নির্বাহী কর্মকর্তা পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ল্যারি নক্সের নাম। সুসান বারর্গফ অ্যাডাম হিচকক এসআইজির পরিচালক।

ইউনাইটেড স্টেটস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে দেয়া প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ১১ জন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ৩৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার মূলধন সংগ্রহ করে এসআইজি। এরপর ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তার কাছ থেকে ৬০ লাখ ২২৩ ডলার মূলধন সংগ্রহ করা হয়। হিসাবে কোম্পানিটির মোট মূলধনের পরিমাণ ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ২২৩ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৮২ কোটি টাকা। মূলধন জোগান দেয়া বিনিয়োগকারীদের তথ্য গোপন রাখতেই ২০১৯ সালের মে এসআইজির সিইও ল্যারি নক্স যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে আবেদন করেন। কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে ১০ জন কর্মীর যে পরিচয় দেয়া হয়েছে তাতে সবাইকে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

দেশে বড় বড় ব্যাংক থাকতে হঠাৎ করে বিডি ফাইন্যান্সের মতো ছোট একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বিদেশী বিনিয়োগ আসার সংবাদে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। নিয়ে দেশের আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা উষ্মাও প্রকাশ করেছেন।

বিডি ফাইন্যান্সের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরের আগে এসআইজির নামই শোনেননি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিডি ফাইন্যান্সের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরের পর গণমাধ্যমে আসা সংবাদ থেকে এসআইজির নাম জেনেছি। এর আগে দেশের ব্যাংক খাতে যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে, সেগুলো বৈশ্বিকভাবে সমাদৃত। উন্নত দেশগুলোর যেসব প্রতিষ্ঠান স্বল্প উন্নত দরিদ্র দেশগুলোতে বিনিয়োগ করে, সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা জানি। কিন্তু হঠাৎ করে বাংলাদেশে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দেয়া এসআইজির নাম কখনো শুনিনি।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আসার জন্য বিশ্বের বহু দেশে ঘুরেছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস খান। তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ আনার জন্য বিশ্বের বহু সংস্থা সংগঠনের সঙ্গে দেখা করেছি। অনেক চেষ্টার ফল হিসেবে নরফান্ড বিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছে। তবে এসআইজি নামে কোনো মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের নাম কখনো শুনিনি। বিডি ফাইন্যান্সের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরের পর কোম্পানিটির নাম জেনেছি।

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) হিসেবে ১৯৯৯ সালের ২২ ডিসেম্বর কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (বিডি ফাইন্যান্স) ২০০৭ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিডি ফাইন্যান্সের অন্যান্য দায় মূলধনসহ আমানত ছিল হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। একই সময়ে হাজার ২৯০ কোটি টাকার ঋণ লিজ ছিল প্রতিষ্ঠানটির। সব মিলিয়ে বিডি ফাইন্যান্সের দায় সম্পদের পরিমাণ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ৪৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফার বিপরীতে ৩১ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছে বিডি ফাইন্যান্স।

গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদরে বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বিডি ফাইন্যান্সের প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ছিল টাকা ৯০ পয়সা। এক বছর পর চলতি জুলাইয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর ৫৩ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। চলতি বছরের এপ্রিলেও বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি মূল্য ছিল ৩০ টাকার নিচে। কিন্তু এসআইজির সঙ্গে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের এমওইউ স্বাক্ষরের পর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের মতোই সভরেইন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ বা এসআইজির নাম শোনেননি বলে জানান ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান . আহসান এইচ মনসুর। ক্যারিয়ারের দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করা বিশেষজ্ঞের বক্তব্য হলো বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পিপিপিতে বিদেশী বিনিয়োগ আলোর মুখ দেখেনি। চায়নিজরা যেসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল, সেগুলো বাতিল হয়ে গেছে। ইতাল-থাই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে বিনিয়োগ করতে গিয়েও অর্থের সংকটে লেজেগোবরে পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আর্থিক খাতে এখন পর্যন্ত হওয়া সব বিদেশী বিনিয়োগ এক করলেও অর্ধবিলিয়ন ডলার হবে না। অবস্থায় এসআইজি নামের প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে বিডি ফাইন্যান্সের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে, সেটি বোধগম্য নয়।

ধরনের ঘোষণার কোনো মূল্য নেই বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেনএসআইজি কোন খাতে বা প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে, সেটিই ঠিক হয়নি। আকাশকুসুম ঘোষণাটি যদি পুঁজিবাজারে বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারদর বাড়ানোর জন্য দেয়া হয়ে থাকে, সেটি দুঃখজনক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা তলব করা দরকার।

এসআইজির সঙ্গে স্বাক্ষরিত এমওইউতে বিডি ফাইন্যান্সের পক্ষে স্বাক্ষর করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়ছার হামিদ। বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এমওইউর শর্ত অনুযায়ী ২০০ কোটি ডলারের মধ্যে কোটি ডলার আমরা নিজেরা দেশের বিভিন্ন খাতে অর্থায়ন করব। বাকিটা এসআইজির মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রকল্পের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা বিশ্লেষণ করে বিষয়ে এসআইজির কাছে প্রতিবেদন দেবে বিডি ফাইন্যান্স। এর ভিত্তিতে এসআইজি সেই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। কাজের জন্য আমাদের ফি দেয়া হবে। বিডি ফাইন্যান্স এক্ষেত্রে মূলত কাস্টডিয়ানের ভূমিকা রাখবে।

এমওইউ স্বাক্ষরের পর কার্যক্রম কতটুকু এগোল? এমন প্রশ্নের উত্তরে কায়ছার হামিদ বলেন, এসআইজির সিইও ল্যারি নক্সের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগের খাতগুলোর বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছি। তবে এসআইজির তহবিলের উৎস সম্পর্কে কায়ছার হামিদ জ্ঞাত নন বলে জানান। যুক্তরাষ্ট্রে এসআইজির কার্যালয় দেখতে গিয়েছিলেন কিনাএমন প্রশ্নের জবাবে কায়ছার হামিদ বলেন, আমি যাইনি। আমাদের চেয়ারম্যান এমওইউ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন