কভিড-১৯ মহামারীতে বিপর্যস্ত বিশ্বে লিঙ্গভিত্তিক সমতা আর ন্যায়বিচারের বার্তা দিয়ে শুরু হলো ‘টোকিও
অলিম্পিক গেমস ২০২০’। জাপানের রাজধানীতে ১৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে নবনির্মিত ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টায় শুরু হওয়া জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পর্দা উঠল ৩২তম এশিয়াডের।
জাপানের সম্রাট নারুহিতো রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে একাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে তার পরিবারের অন্য কেউ গৌরবের এ ক্রীড়া আসরের উদ্বোধনীতে অংশ নেননি। কভিডের কারণে ৭০ হাজার দর্শক ধারণক্ষম স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন মাত্র ৯৫০ জনের মতো অতিথি। অতিথিদের মধ্যে বিদেশী ৮০০ জন আর স্বাগতিক জাপানের ছিলেন মাত্র ১৫০ জন। অতিথিদের মধ্যে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ আর আমেরিকান ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন উল্লেখযোগ্য।
গত বছর ঠিক এ সময় টোকিওতে মাঠে গড়ানোর কথা ছিল অলিম্পিক আসরের। যদিও নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ঘটায় অ্যাথলিটরা এতে অংশ নিতে আশঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন। পাশাপাশি জাপানি নাগরিকদের একটি বড় অংশও মহামারীর মধ্যে অলিম্পিক আয়োজনের বিরোধিতা করলে আয়োজকরা পিছু হটেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরটি বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা বাদে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পিছিয়ে যায়। এ বছরও ছিল অনেক অনিশ্চয়তা, অনেক সমালোচনা। গতকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মুহূর্তেও স্টেডিয়ামের বাইরে অলিম্পিক বাতিলের জন্য বিক্ষোভ হয়েছে। তাদের দাবি ছিল, অলিম্পিক আয়োজন করে মানুষের মৃত্যু ঘটাবেন না।
যদিও সব অনিশ্চয়তার অবসান ঘটল। অবশেষে সূর্যোদয়ের দেশে জ্বলল অলিম্পিক মশাল। দ্বিতীয়বারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করল অলিম্পিক গেমস। অ্যাথলিটদের মার্চপাস্টের পর গেমসের উদ্বোধন করেন সম্রাট নারুহিতো। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ক্রীড়া আসর চলবে আগামী ৮ আগস্ট পর্যন্ত। এতে অংশ নেবেন ১১ হাজারের মতো অ্যাথলিট।
গতকাল মার্চপাস্টে সবার আগে ছিল প্রথম অলিম্পিকের আয়োজক দেশ গ্রিসের অ্যাথলিটদের দল, এরপর অলিম্পিকের শরণার্থী দল, যারা এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো অলিম্পিক পতাকা নিয়ে অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করছে। সবশেষে মার্চপাস্টে যোগদান করে স্বাগতিক জাপানের অলিম্পিক কন্টিনজেন্ট। সব মিলিয়ে ২০৭টি দেশ এবারের আসরে অংশ নিচ্ছে।
এবারের তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, মার্চপাস্টে প্রতিটি দেশের পতাকা বহন করেছেন দু-একজন পুরুষ ও একজন নারী। আবার চেষ্টা করা হয়েছে একাধিক রং ও ভাষাভাষীর অ্যাথলিটকে রাখারও।
বাংলাদেশের পতাকা বহন করেন সাঁতারু আরিফুল ইসলাম। বাংলাদেশের হয়ে এই আসরে অংশ নেবেন মোট ৬ অ্যাথলিট। বাকিরা হলেন সাঁতারু জুনাইনা আহমেদ, দুই আর্চার রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী, স্প্রিন্টার জহির রায়হান ও শুটার আব্দুল্লাহ হেল বাকি। পতাকা বহনের কথা ছিল বাকির, পরে রোমান সানার। যদিও দুজনেরই গতকাল ইভেন্ট থাকায় উদ্বোধনীতে অংশ নিতে পারেননি। ফলে পতাকা বহনের ভার পড়ে আরিফুলের কাঁধে।
মার্চপাস্টের আগে জাপানি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হয় মঞ্চের পারফরম্যান্সে। মূলত এখানে উপস্থাপন করা হয় করোনা মহামারীর কঠিন সময়ে অ্যাথলিটদের কীভাবে সময় কাটাতে হয়েছে, অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এসব সুনিপুণভাবে তুলে ধরেন তোসুবাতা আরিসা; যিনি একই সঙ্গে নার্স ও বক্সার। ফিট থাকতে একাকী ট্রেড মিলে দৌড়েছেন আর্সিয়া, যার মধ্যে ফুটে উঠেছে করোনা মহামারীর সময়ে সারা বিশ্বের অ্যাথলিটরা ঘরে একা অনুশীলন চালিয়ে যেতে কতটা কষ্ট করেছেন।
এর আগে ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক গেমস আয়োজন করে টোকিও। এটা জাপানি রাজধানীর দ্বিতীয় অলিম্পিক আয়োজন। গতকাল অলিম্পিক স্টেডিয়ামে আনা হয় অলিম্পিক রিং। তাতে ফিরে আসে টোকিওর ১৯৬৪ আসরের স্মৃতি। রিংয়ের সাতটি বৃত্ত তৈরি করা হয়েছে সেই গাছের কাঠ দিয়ে, যে গাছগুলো ১৯৬৪ সালের অ্যাথলিটরা লাগিয়েছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিল অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলন অনুষ্ঠান। হাইতিয়ান বাবা আর জাপানি মায়ের সন্তান টেনিস সুপারস্টার নাওমি ওসাকা জাপানের নাগরিক হিসেবেই খেলেন। জাপানের এই ক্রীড়া আইকন গতকাল শেষ বাহক হিসেবে মশাল বহন শেষে ক্যালড্রনে অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলন করেন, যা জ্বলবে ৮ আগস্ট গেমসের শেষ দিন পর্যন্ত।
এদিকে অলিম্পিকের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ‘দ্য
অলিম্পিক লরিয়েল’ অ্যাওয়ার্ড পেলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। টোকিওতে গতকাল অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে ভার্চুয়ালি যুক্ত হলে তাকে এ অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।
এক বিবৃতিতে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) জানিয়েছে, ক্ষুদ্র ঋণ ধারণার মাধ্যমে বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখা ড. ইউনূস ক্রীড়া উন্নয়নেও বিশাল অবদান রেখেছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাকে এ অ্যাওয়ার্ড দেয়া হলো।
খেলাধুলার মাধ্যমে সংস্কৃতি, শিক্ষা, শান্তি ও উন্নয়নে অবদান রাখার স্বীকৃতি দিতে পাঁচ বছর আগে ‘দ্য
অলিম্পিক লরিয়েল’ অ্যাওয়ার্ডের সূচনা করে আইওসি। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিক গেমসে প্রথম এ পদক দেয়া হয় কেনিয়ার সাবেক অলিম্পিয়ান কিপ কেউনোকে, যিনি নিজ দেশে শিশুদের জন্য ঘর, একটি স্কুল ও অ্যাথলিটদের জন্য একটি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ করে দেন।