বিশ্বের ১০১টি দেশে এখন কভিড-১৯ সংক্রমনের গতি ঊর্ধ্বমুখী। সংক্রমণের চূড়ায় অবস্থান করছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোয় সংক্রমণের হার কমে এলেও বাংলাদেশে পরিস্থিতি এখনো দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলোর মতো আশঙ্কাজনক। যদিও গত কয়েকদিনে সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কমেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধিনিষেধ কঠোরভাবে প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতির আবারো অবনতি হতে পারে।
দৈনিক নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় বাংলাদেশে এখন শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ওপরে। মূলত করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঘটায় সংক্রমণ ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ও টিকাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়াও সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বে মোট শনাক্তের ২৮ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে, ২৬ শতাংশ ইউরোপে, ২৪ শতাংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, ১০ শতাংশ পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে, ৬ শতাংশ আফ্রিকায় ও ৬ শতাংশ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে সংক্রমণ বাড়ছে। একই সঙ্গে কাছাকাছি দেশ হিসেবে বাড়ছে বাংলাদেশের সংক্রমণও। অন্যদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে দক্ষিণ এশিয়ায় রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। পরিসংখ্যান বলছে, আফগানিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকায় প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়, তার দ্বিগুণ আক্রান্ত হয় মালদ্বীপ ও পাকিস্তানে। আর এখন এ দুটি দেশের দ্বিগুণ আক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশে।
দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সাতটি দেশে চলতি মাসের শুরুতে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত সংখ্যা কমতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়তে দেখা গেছে। ঈদের ছুটিতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমলে শনাক্তের সংখ্যা কমে যায়। এর পরও বাকি দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ৬৫ হাজারের বেশি মানুষের শরীরে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সর্বশেষ নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় দেশে শনাক্তের হার ৩১ শতাংশের বেশি। মোট মৃত্যুহার ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় সাত হাজার ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। আর মারা যান ১১১ জনের বেশি করোনা রোগী।
আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গত সাতদিনে এশিয়ায় ৭ শতাংশ রোগী বেড়েছে। একই সঙ্গে মৃত্যুহার বেড়েছে ১১ শতাংশ। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উত্পত্তিস্থল ভারতে গত ১ জুন ১ লাখ ৩২ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হলেও চলতি মাসের ১ তারিখে তা ৪১ হাজারে নেমে আসে। তেমনি ৩ জুন প্রায় ছয় হাজার করোনা রোগী নেপালে শনাক্ত হলেও এ মাসের শুরুতে তা এক হাজারে নামে। একইভাবে শ্রীলংকা, ভুটান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে শনাক্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে গত মাসের তুলনায় বাংলাদেশে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাদান কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত না হলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসত। এরই মধ্যে বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশ ভারত তাদের মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশকে টিকার আওতায় এনেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ কেবল তার মোট জনসংখ্যার আড়াই শতাংশের কিছু বেশি মানুষের শরীরে পূর্ণাঙ্গ ডোজ টিকা প্রয়োগ করতে পেরেছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশে সংক্রমণ হার কমে এলেও মার্চের পর থেকেই তা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে।
চলতি জুলাইয়ের প্রথম ১৫ দিনেই সবচেয়ে বেশি বা দেড় লাখ মানুষ নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এ সময় তিন হাজারের বেশি কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর মৃত্যু হয়। এর আগে এপ্রিলে বেশি মৃত্যু থাকলেও জুলাইয়ের সংখ্যা সে পরিসংখ্যানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। ১২ জুলাই দেশে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৭৬৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়। এরপর নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমতে থাকায় শনাক্তের সংখ্যা কমে আসে। সংক্রমণ বাড়ায় দেশে সুস্থতার হারও কমেছে। জুনের শুরুতে সুস্থতার হার ৯২ শতাংশ থাকলে তা বর্তমানে ৮৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ঈদুল আজহার ছুটিতে শনাক্তের সংখ্যা কমলেও স্বল্পসময়ের ব্যবধানে তা বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরামর্শক এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, এখন আফ্রিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সংক্রমণ কমলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সংক্রমণ কমাতে হলে যে ধরনের বিধিনিষেধ মানা প্রয়োজন, তা আমাদের দেশে মানা হচ্ছে না। বিশ্বের যেসব দেশে এখন করোনা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেসব দেশে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি ও সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ মানা হয়েছিল। একই সঙ্গে সরকার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বিধিনিষেধ জারি করেছিল। সম্পূর্ণভাবে বিধিনিষেধ মানা হলে ও টিকাদান কার্যক্রম পুরোদমে চালানো গেলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে।
বিধিনিষেধ সঠিকভাবে মানলে সংক্রমণ কমে আসবে, তবে নিয়ন্ত্রণে আসতে আরো সময় লাগবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, যত বেশি সংক্রমণ বাড়বে তত বেশি মৃত্যু বাড়বে। বিধিনিষেধের শিথিলতায় স্বাস্থ্যবিধির সঠিক প্রতিপালন হয়নি। এর প্রভাব আর কিছুদিন পর দেখা যাবে। বর্তমানে যে বিধিনিষেধ চলছে তার সুফল পেতে হলে এর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।