বিশ্বের ৬৪টি দেশের মধ্যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালেও বেনিন, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, কোস্টারিকা ও পাকিস্তানের চাইতে পিছিয়ে ছিল ভারত। কিন্তু ২০২০ সালে এসে ভারত বিশ্বের সর্বোচ্চ এফডিআই পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। বাণিজ্য ও উন্নয়নসংক্রান্ত জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে। খবর দ্য প্রিন্ট।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯০-৯১ সালে ভারতে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ সালে এসে সে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ১৭২ কোটি ২০ লাখ ডলারের বেশি। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক এ তথ্য দিয়েছে। গত তিন দশকে ভারতে এমন কী পরিবর্তন এসেছে যে, দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী বিনিয়োগের জন্য দেশটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে?
সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন খাতে সুযোগ তৈরি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিভিন্ন দেশের সরকার বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির জন্য নতুন নতুন খাত সংস্কার করে। ভারতে প্রথম বিদেশী বিনিয়োগের প্রসার শুরু হয় ১৯৮০ সালে। তখন কেবল নির্দিষ্ট কিছু বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ভারতে কাজ শুরু করে। তবে সে সময় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ভারতের নীতি খুব কঠিন ছিল। কেবল যৌথ উদ্যোগে ও নির্দিষ্ট ৪০ শতাংশ শেয়ার নিয়ে ব্যবসা করতে হতো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। তবে ১৯৯১ সালের পর এসব বদলে যায়। এরপর থেকে ভারত বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এসব উদ্যোগকে মূলধনের চেয়েও স্থিতিশীল বলে মনে করা হয়।
তবে ভারতের এ পরিবর্তন মোটেও সহজ ছিল না। শুরুতেই বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ শেয়ারের যে বাধ্যবাধকতা ছিল সেটি তুলে নেয়া হয়। সেইসঙ্গে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে এ পরিমাণ ক্ষমতা দেয়া হয় যেন তারা বিদেশী সমঅধিকার বিনিয়োগের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদন দিতে পারে। শুরুতে ৩০টি শিল্প খাতের জন্য অনুমোদন দেয়া হলেও ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়তে থাকে।
বিদেশী মূল সংস্থা থেকে ভারতীয় যৌথ উদ্যোগে প্রযুক্তি স্থানান্তরকে আরো সহজ করার জন্য এক্ষেত্রে যে কঠিন বিধিনিষেধ ছিল তা শিথিল করা হয়। এফডিআই আকৃষ্ট করতে প্রযুক্তি ও রয়্যালটির ওপর যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তাও কমিয়ে আনা হয়।
আর এসবের বদৌলতেই এখন ভারতে সাশ্রয়ী মূল্যে টেলিভিশন সেট পাওয়া যায়, নতুন নতুন মডেলের গাড়ি তৈরি হয়, ভোক্তাদের জন্য টেকসই পণ্য উৎপাদন হয় এবং সবচেয়ে নতুন যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারেন ভারতীয়রা। বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির কারণেই সনি বা মিত্সুবিশির মতো প্রতিষ্ঠান ভারতে তাদের উৎপাদন শুরু করতে পেরেছিল, যার সুফল আজকের ভারতবাসী পাচ্ছে।
তবে এটাও ঠিক, এ পর্যন্ত আসার পথটি সুগম ছিল না। এফডিআইয়ের জন্য নানা বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেয়ার বিপক্ষে ছিলেন তত্কালীন বিরোধী দলের নেতারা। এমনকি ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের অনেক নেতাও এর বিরোধিতা করেছিলেন। সরকারকে নানাভাবে দোষারোপ করা হচ্ছিল। ভারতের শীর্ষ শিল্পোদ্যোক্তারাও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এজন্য তত্কালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে তারা স্মারকলিপিও জমা দেন। যেখানে বলা হয়, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুযোগ দেয়ার আগে দেশী ব্যবসায়ীদের জন্যও ব্যবসার সমান ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এ রকম নানা বাধা পেরিয়ে এফডিআইয়ের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে ভারত, যার সুফল এখন স্পষ্টই পাচ্ছে দেশটির আপামর মানুষ। বিদেশী বিনিয়োগের কারণে যেমন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি এসেছে তেমনি নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।