খানদের সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত?

তিন দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দর্শকদের বিনোদন দিয়েছেন বলিউডের তিন খান। তবে এখন মনে হচ্ছে ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে ত্রিরত্নের প্রভাব, তাদের তারকাখ্যাতির ক্যারিশমা।

ভারতীয় মিডিয়া বিশ্লেষক করণ তৌরানি ২০১৮ সালে দেখিয়েছিলেন, সে বছর চলচ্চিত্রের সংখ্যায় চল্লিশোর্ধ্ব তারকাদের পেছনে ফেলেছিলেন আয়ুষ্মান খুরানা, ভিকি কৌশল, শহীদ কাপুর রণবীর কাপুর। তরুণ তারকাদের ছবির সংখ্যা ছিল ৪৬, অন্যদিকে চল্লিশোর্ধ্বদের ছবি ৩৮টি। তরুণদের ছবি বক্সঅফিসেও ভালো করেছিল। প্রযোজক পরিচালকরা বুঝতে পারলেন -ক্যাটাগরির তারকাদের জন্য বিপুল খরচ করে ছবির মুনাফার মার্জিন না কমিয়ে তরুণরা বরং ভালো বিকল্প হয়ে উঠছেন। বড় তারকাদের নিয়ে কাজ করে এতদিন প্রযোজকরা কেবল মোট আয়ের ১০ ভাগ নিজের ঘরে তুলতে পারতেন। সব মিলিয়ে এখন স্পষ্ট যে বলিউড মানে আর খানরা নন।

২০২০ সালের শুরুতে ভারত এক নতুন ঘটনার সাক্ষী হয়। ১৯৮৮ সালে তিন খানের অভিষেকের পর এই প্রথম তাদের কেউ ভারতীয়দের নিত্যদিনের খোশগল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হন। জিরো ছবিতে নিজের ব্যর্থতার ক্ষত মেরামতে শাহরুখ ব্যস্ত ছিলেন। আমির শুরু করেছিলেন লাল সিং চাড্ডার শুটিং। আর সালমান ব্যস্ত ছিলেন তার পেশি আর ইমেজ নিয়ে রাধে: ইয়োর মোস্ট ওয়ান্টেড ভাইয়ের কাজে। বলে রাখা ভালো, বছর ঈদুল ফিতরে রাধে মুক্তি পেলেও ছবিটি সমালোচক-দর্শকদের টানতে পারেনি। সালমানের অভিনয় বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবেও ছবিটি বড় কোনো সাফল্য পায়নি।

শাহরুখ, আমির, সালমানতিন খানেরই জন্ম ১৯৬৫ সালে। এবার সত্যিই মনে হচ্ছে বলিউডে শেষ হতে যাচ্ছে খানদের যুগ। ২০১৮ সালে থাগস অব হিন্দুস্তানের ব্যর্থতার পর এখনো আমির খানের নতুন কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। শাহরুখের রাহুল/রাজের রোমান্টিক লুক কিংবা যুগ এখন বলিউডের অতীত। রোমান্টিক ক্যারিশমা দিয়ে শাহরুখের আর নতুন কিছু করার সুযোগ নেই। সালমানের পেশি কিংবা ভাইজান ইমেজও আর কুলোচ্ছে না। যতই নিজের তরুণ ইমেজ তিনি ধরে রাখতে চান না কেন, পর্দায় নায়িকাদের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্যটা বেশ ভালোভাবেই চোখে পড়ছে।

খানদের ফুরিয়ে যাওয়ার সমান্তরালে বদলাচ্ছে ভারতও। দেশটির সমাজ, রাজনীতি, ধর্মীয় বাতাবরণে গত কয়েক বছরে বেশ ভালোই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় সাংবাদিক, লেখক কাবেরী বামজাই লিখেছেন, ভারতীয়দের কল্পনার জগতে এখন বড় রাজনৈতিক নেতারা জায়গা করে নিয়েছেন। মিডিয়ায় ক্রমাগত সহায়ক প্রচারণা অনেক নেতাকে রীতিমতো তারকা হিসেবে তৈরি করেছে। পাবলিক ফিগার হিসেবে অন্য কারোর জায়গা আর থাকছে না। তিন খানও অবশ্য একসময় তা- করেছিলেন। ভারতীয়দের সামাজিক মানসিকতাকে তারা ঐতিহ্যবাহী প্রথাগত দুনিয়া থেকে আধুনিক দুনিয়ায় টেনে আনতে ভূমিকা রেখেছেন। ভারতের সামাজিক পরিসরে নানা রকম পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিন খান।

যুগের পরিবর্তনে সমাজে স্থিতির সংস্কৃতি ক্ষয়ে গেছে, যেকোনো কালের তুলনায় সমাজ এখন অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন মনে করেন, খানদের আধিপত্যকে বুঝতে হলে বলিউডে তারকাদের কুলুজি সংস্কৃতি মাথার রাখতে হবে। পঞ্চাশের দশকে আধিপত্য ছিল দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার রাজ কাপুরের। দেব দিলীপ ছিলেন মধ্যবিত্তের নায়ক। রাজ কাপুর এনেছিলেন চ্যাপলিনের ভাব। ষাটের দশকের শেষে দেখা গেল দুজন নিজেদের মতো ইমেজে জায়গা করে নিয়েছেন। রাজেশ খান্না তার রোমান্টিক লুকে আর নগরের সহিংসতা গল্পের একচ্ছত্র অধিপতি অ্যাংরি ইয়াং ম্যান অমিতাভ বচ্চন। এর পরই আগমন তিন খানের। সালমান তার তারুণ্য, কৌতুকময় ইমেজে কখনো বড় হতে চাননি। আমির ছিলেন পরিণত; অভিনয়, গল্প নিয়ে নানামুখী নীরিক্ষা করেছেন। তবে বয়স যে খানকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করেছে, তিনি শাহরুখ। বয়স বাড়তেই উড়ে গেছে যার ম্যাজিক। তবে ভারতীয় মধ্যবিত্তের বিকাশে সবচেয়ে বড় ছাপ ছিল শাহরুখেরই।

২০২০ সালটি ছিল খানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গুজব ছিল শাহরুখ ফিরবেন রাজকুমার হিরানির সঙ্গে একটি ছবি দিয়ে। হিরানির কাজে শাহরুখ বাজারে নতুন করে আত্মবিশ্বাস ছড়াতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছিল। আর আমির সালমান বিনোদনমূলক বড় ছবি নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই হয়নি। কভিড মহামারী সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু বদলে দিয়েছে বলিউডকে। সবখানে কথা উঠলবলিউডের ক্ষমতাবান সিনিয়রদের চক্রান্তে তরুণ এক তারকার প্রাণ গেল। বিশেষত সালমান খানকে এজন্য বিশেষভাবে দায়ী করা হয়। কফি উইথ করণে সুশান্তকে তাচ্ছিল্য করার একটি ভিডিও ক্লিপ দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন সময়ে খানদের কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। স্বাভাবিকভাবেই নীরবতা তাদের ভক্তদের কানেও বেজেছে। সুশান্ত সবসময় শাহরুখের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, সেই শাহরুখও তরুণের মৃত্যুতে কবরের নীরবতা অবলম্বন করেছেন। খানদের নীরবতা শুধু তাদের ক্যারিয়ার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলিউডকেও। ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের অনেকেও সমালোচনা শুরু করেন। জনমত বিপুলভাবে বলিউডের ক্ষমতাধর তারকাদের বিরুদ্ধে চলে যায়, যার বড় লক্ষ্য তিন খান। এর মধ্যে সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা অক্ষয় কুমার একের পর এক হিট উপহার দিয়েছেন। তিনি একাই খানদের বাজার অনেকটা টলিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে স্ট্রিমিং সার্ভিস বিদেশী সিরিজগুলো এখন নতুন জায়গা নিচ্ছে। দর্শকরা নানা ধরনের কাহিনী দেখে অভ্যস্ত হচ্ছে। তাই খানদের ব্যক্তিত্ব আর ইমেজনির্ভর সাম্রাজ্য ধীর ধীরে ক্ষয় হচ্ছে। নতুন তারকারা বরং নতুন পরিস্থিতিকে সঙ্গে নিয়েই বড় হচ্ছেন।

 

কাবেরী বামজাইয়ের সানসেট অন খান মার্কেট শীর্ষক রচনা অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন