কভিডের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলা

টিকাদান কার্যক্রম জোরদার ও স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করা হোক

বিশ্বের শতাধিক দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয় গত তিন সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, আর মৃত্যুবরণ করছে দেড় শতাধিকের বেশি হার্ভার্ডের মহামারী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাদান স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলা অসম্ভব অবস্থায় সরকার মাসের শুরু থেকে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু করে কিন্তু লকডাউনের ফল লাভ করার আগেই কোরবানির ঈদ চলে আসায় সরকার এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন শিথিল করে ঈদের সময় দেশব্যাপী বিপুল জনগণ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করায় এবং প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ কার্যত ব্যর্থ হওয়ায় স্বাস্থ্যবিশারদরা আশঙ্কা করছেন যে ঈদের এক থেকে দুই সপ্তাহ পর দেশব্যাপী করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে পারে পরিপ্রেক্ষিতে হার্ভার্ডের মহামারী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় টিকাদান কর্মসূচির প্রয়োগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া করোনার ডেল্টা ধরন মোকাবেলা করা একেবারেই অসম্ভব বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের ৭০ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ফলে হার্ভার্ডের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন

বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে করোনার মতো দীর্ঘস্থায়ী মহামারী মোকাবেলা করা সহজ কাজ নয় একদিকে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, অন্যদিকে জীবিকা রক্ষার চেষ্টা করাসব মিলিয়ে যেকোনো সরকারের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ বিশ্বের উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশে সবার সামাজিক সুরক্ষা না থাকায় অসংখ্য মানুষ করোনা মহামারীর সময়ে কাজ হারিয়ে খাদ্য সংকটে ভুগছে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো টিকার আওতার বাইরে রয়ে গেছে ফলে দেশে একটি মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে এর আগে আমরা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ডেল্টা স্ট্রেইনের ভয়ংকর রূপ দেখেছি তাই আমাদের আতঙ্কিত শঙ্কিত না হয়ে থাকার উপায় নেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে ভারতের দৈনিক সংক্রমণ হয়েছে চার লাখের বেশি, মৃত্যু হয়েছে চার হাজারের বেশি আর হিসাব ছিল সেই দেশের সরকার প্রদত্ত তথ্য অন্যদিকে বিবিসি, সিএনএনসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তাদের তথ্যানুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন সমীক্ষাভিত্তিক রিপোর্টে বলেছে, সে দেশের সরকার প্রদত্ত সংক্রমণ মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বকে এটি বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলতে পারে বলে পুনরায় সতর্ক করে দিয়েছে একই সঙ্গে এটির আরো কাঠামোগত চারিত্রিক রূপান্তর ঘটে চলেছে শুধু তা- নয়, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মিউটেশন হয়ে আবার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্লাসে রূপান্তর হয়েছে, যা ইউরোপের কয়েকটি দেশে শনাক্ত হয়েছে এমন অবস্থায় টিকাদান জোরদার স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের বিকল্প নেই 

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) দেশটির নাগরিকদের জন্য এরই মধ্যে ডেল্টার সংক্রমণ প্রতিরোধ নিয়ে এক গাইডলাইন জারি করেছে এতে বলা হয়েছে, টিকা নেয়ার পরও মার্কিন নাগরিকদের মাস্ক পরে চলাচল করতে হবে সিডিসির গাইডলাইনের সমর্থনে হার্ভার্ডের গবেষক উইলিয়াম হ্যানেজ বলেছেন, টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের পরিস্থিতি মারাত্মক দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম কিন্তু টিকা না নেয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন আমার উপদেশ হলো, মহামারী এখনো শেষ হয়নি যদি কেউ টিকা না নিয়ে থাকে, তবে তাকে অবশ্যই তা নিতে হবে এছাড়া স্থানীয় পরিস্থিতির দিকে নজরও রাখতে হবে যদি কেউ ডেল্টায় সংক্রমিত না হতে চায়, তাকে অবশ্যই জনসমাগমের স্থানগুলোয় মাস্ক পরতে হবে এবং যেসব এলাকায় ডেল্টার সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, সেসব এলাকায় সামাজিক শারীরিক দূরত্বের বিষয়টি অবশ্যই বজায় রাখতে হবে

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা বা মুক্তি পেতে মুহূর্তে জরুরি দ্রুত ভ্যাকসিন কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা এবং এরপর কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে রয়েছে পাবলিক প্লেসে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা, সঠিক নিয়মে ২০ সেকেন্ড ধরে ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং কমপক্ষে তিন ফুট সামাজিক বা দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা নভেল করোনাভাইরাসের সব প্রকার ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় তিনটি বিষয়ের ওপর সার্বিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আমাদের দেশে এখন কঠোর লকডাউন চলেছে কিন্তু কঠোর লকডাউনে পথে-ঘাটে-মাঠে জনসাধারণের অবস্থান কিছুটা কমে এলেও তা সন্তোষজনক নয় অন্যদিকে যাদের বাইরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দৃশ্য চোখে পড়ছে না মানুষকে দৈনন্দিন খবরাখবর দেখে অবস্থা বুঝে নিজেদেরই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সতর্ক সচেতন হতে হবে

আগের দিনের সংক্রমণ মৃত্যুহারের সংখ্যাচিত্র পরের দিনই উদ্বেগজনক হারে ছাড়িয়ে যাচ্ছে সংক্রমণের খাড়া গতির জেলাওয়ারি পরিস্থিতি বিশ্নেষণে বলা যায়, বিদ্যমান সংকটের জন্য জন-উদাসীনতা কিংবা অসচেতনতা বহুলাংশে দায়ী আমরা জানি, গত ঈদুল ফিতরের পূর্বাপর ঈদকেন্দ্রিক যাতায়াতের কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল ঈদুল আজহায়ও নানাভাবে মানুষ ঘরে ফিরেছে এমন বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে এক বছরেরও বেশি সময়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে অনেকটাই জানা সত্ত্বেও মানার ক্ষেত্রে মানুষের অনীহার ফলে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে পরিবার-সমাজ ঝুঁকির মুখে থাকবে জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্য, চলমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কতদিন অব্যাহত থাকবে তা বলা মুশকিল পরিস্থিতিতে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে ব্যত্যয় ঘটলে পরিণতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, তা সহজেই অনুমেয় আমরা জানি, যেকোনো রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা-সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই একই সঙ্গে গণটিকাদান কার্যক্রম পরিকল্পনাও বিন্যস্ত করা জরুরি

বিশ্বের অনেক দেশ করোনা দুর্যোগে কৌশলগত পরিকল্পনা করেই অগ্রসর হয়েছে এবং প্রয়োজনে কৌশল পরিবর্তন করে সময়োপযোগী ব্যবস্থায় সফলতাও অর্জন করেছে জনগণকে সম্পৃক্ত করে আমাদেরও লক্ষ্যে এগোনো দরকার সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে না পারলে সব ব্যবস্থার পরিসর বাড়িয়েও প্রত্যাশিত ফল মিলবে না একথা সত্য, লকডাউন দীর্ঘদিন চালানো আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কঠিন লকডাউন না দিয়েও শুধু স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেই বিশ্বের কোনো কোনো দেশ সংক্রমণ রোধ করতে সক্ষম হয়েছে দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে বিভিন্ন উত্স থেকে টিকা সংগ্রহের পথ ক্রমেই মসৃণ হচ্ছে, সেহেতু সংক্রমণের মাত্রা যেখানে বেশি ঊর্ধ্বমুখী, টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে সেসব এলাকায় নজর বাড়ানো যেতে পারে  পাশাপাশি স্থান ভেদে কঠোর লকডাউনে যেতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তরের মধ্যে আরো সমন্বয় অপরিহার্য স্বাস্থ্য বিভাগের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা নিয়ে এরই মধ্যে বিস্তর কথা হলেও তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের প্রস্তুতি সক্ষমতা কতটা, নিয়ে এখনো প্রশ্ন আছে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারকে কৌশল সুনির্দিষ্ট করে সরকার নাগরিক সমাজের করণীয়গুলো জনগণের কাছে আরো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা দরকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন