বিশ্বব্যাপী অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি

বণিক বার্তা অনলাইন

কভিডপরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতির একটি বড় মাপকাঠি হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও পর্যটন খাত। মহামারীর কারণে ২০২০ সালে বৈশ্বিক পর্যটন খাতে ভ্রমণকারীর যাতায়াত সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭৪ শতাংশ। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় আন্তর্জাতিক ভ্রমণ খাতে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ প্রত্যাবর্তনের আশা জাগাচ্ছে বিশ্বব্যাপী কভিডের টিকাকরণ কার্যক্রম। এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী টিকা প্রয়োগ হয়েছে মোট ৩৭০ কোটি ডোজ। টিকার সুরক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অনেক ভ্রমণকারীই এখন বিদেশ ভ্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সব টিকার গ্রহীতাদের সমান সুযোগ দিতে রাজি নয়। লন্ডনভিত্তিক দি ইকোনোমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সবচেয়ে বেশি।

অনেক দেশের সরকারই এখন নির্দিষ্ট কিছু টিকার গ্রাহককে ভ্রমণকারী হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জানিয়েছে, অঞ্চলটি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কভিশিল্ড টিকাগ্রহণকারীদের ভ্রমণকারী হিসেবে গ্রহণ করবে না। অথচ ইইউ অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোয় অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণকারীদের ঠিকই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। আবার অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ও কভিশিল্ডের টিকা আদতে একই। কেবল উত্পাদনকারী ভিন্ন।

কভিশিল্ড গ্রহণকারীদের ঢুকতে না দেয়ার কারণ সম্পর্কে ইইউ বলছে, আঞ্চলিক ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এখনো এর অনুমোদন দেয়নি। ফলে এ টিকা অঞ্চলটিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কভিশিল্ডের উত্পাদনকারী দেশ ভারতের সরকার এর পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে ঠিকই। তবে তাতে আশঙ্কা কাটেনি কভিশিল্ড গ্রহণকারীদের। বিশ্বের অনেক দেশেই মানুষ কভিশিল্ডের টিকা নিয়েছে। যেমন শুধু যুক্তরাজ্যেই টিকাটি প্রয়োগ করা হয়েছে ৫০ লাখ ডোজ। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ পর্যন্ত কভিডের যেসব টিকায় স্বীকৃতি দিয়েছে, সেগুলো হলো— অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত টিকা। এর মধ্যে সবগুলোই সব দেশের সরকারের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ভ্রমণবিষয়ক ওয়েবসাইট ভিসাগাইড.ওয়ার্ল্ড-এর তথ্যে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। এ পর্যন্ত ১১৯টি দেশের সরকার এ টিকাকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম স্বীকৃত টিকা হলো চীনের ক্যানসিনোবায়োর উদ্ভাবিত টিকা। এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি দেশ এতে স্বীকৃতি দিয়েছে।

টিকার গ্রহণযোগ্যতার এ ভিন্নতার কারণে সৃষ্ট সংকট শুধু আন্তর্জাতিক ভ্রমণেই সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য টিকা গ্রহণের প্রমাণ চাওয়া হয়নি এখনো। যদিও কানাডায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাগ্রহণকারীদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তারা মার্কিন বেশ কিছু বিনোদন কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। এসব বিনোদনকেন্দ্রে শুধু মার্কিন ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এফডিএ অনুমোদিত টিকাগ্রহণকারীদেরই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩০ কোটি ডোজ টিকার অর্ডার দিয়েছে। যদিও তাতে এখনো এফডিএর অনুমোদন মেলেনি। এছাড়া যুক্তরাজ্য, ইইউ, চীন ও ভারত থেকে আগতদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর এখন সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা রয়েছে।

পর্যটন ও ভ্রমণ শিল্প সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভ্রমণকারীরা পর্যটনে উত্সাহী হবে। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) কর্মকর্তা নিক ক্যারিনের বরাত দিয়ে ইকোনোমিস্ট জানাচ্ছে, টিকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যেকার এ মতপার্থক্যের বিষয়টি পর্যটকদের ভ্রমণে উত্সাহিত করার পথে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে ডব্লিউএইচওর সহকারী মহাপরিচালক ম্যারিয়েঞ্জেলা সিমাও জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া টিকার গ্রহীতাদের প্রবেশ করতে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।

ইইউভুক্ত ডজনখানেক দেশ জানিয়েছে, তারা আঞ্চলিক জোটটির নিয়মকানুনকে অগ্রাহ্য করেই কভিশিল্ড গ্রহণকারীদের প্রবেশ করতে দেবে। কিন্তু চীনা ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রে দেশগুলোর এতটা উদার আচরণের সম্ভাবনা কম। টিকাগুলো ডব্লিউএইচওর জরুরি অনুমোদন পেলেও এগুলোর পরীক্ষাকালীন পর্যায়ের তথ্যের দিক থেকে এখনো বেশ ঘাটতি রয়ে গিয়েছে। ফলে চীনা টিকা নিয়ে এখনো ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বেশ সংশয় রয়ে গিয়েছে। তবে ইইউ অঞ্চলের পর্যটন খাত অনেকটাই চীনা নাগরিকদের ওপর নির্ভরশীল। মহামারীর আগে ২০১৯ সালেও ইইউ অঞ্চল ভ্রমণ করেছে ১ কোটি ২০ লাখ চীনা পর্যটক।

সামনের দিনগুলোয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্বীকৃতি পাওয়া বেশ কিছু টিকার জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এর বড় একটি কারণ হলো পুরোপুরি রাজনৈতিক। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব টিকার স্বীকৃতি পেতে বেশ বেগ পোহাতে হতে পারে; সেগুলো হলো— রাশিয়ার স্পুতনিক ৫, ভারতের কোভ্যাক্সিন এবং কিউবার আবদালা ভ্যাকসিন।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ভ্যাকসিন পাসপোর্টে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য খাত সংশ্লিষ্টদের জন্য পরিস্থিতি আরেকটু সংকটজনক হয়ে উঠেছে। অ্যালাবামা, অ্যারিজোনা, ইন্ডিয়ানা ও ফ্লোরিডা এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত আইনও জারি করেছে। নরওয়েজিয়ান ক্রুজ লাইন হোল্ডিংস এরই মধ্যে এ নিয়ে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অঙ্গরাজ্যটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গ্রাহকদের টিকাগ্রহণের প্রমাণ চাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি আইন করেছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক নৌপরিবহন সংশ্লিষ্টদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কারণ যাত্রীদের সবার টিকা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত যাত্রীবাহী জাহাজগুলোর জন্য নোঙর তোলা অনৈতিক ও অসম্ভব কাজ হিসেবে বিবেচিত। সব মিলিয়ে চলতি বছরটিও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টদের জন্য কভিডজনিত হতাশার আরেকটি বছর হয়ে উঠতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বিশেষ করে টিকা নিয়ে আন্তসীমান্ত আমলাতান্ত্রিক যে জটিলতাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোর কারণে পর্যটন খাত আগামী বছরের আগে পুনরুদ্ধারের পথে নাও ফিরে আসতে বলে মনে করছেন তারা।

দি ইকোনোমিস্ট অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন