করোনার সময় ঈদুল আজহা

উৎসব উদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ পরিপালন করা হোক

করোনায় দেশে মৃত্যু সংক্রমণের হার বাড়ছে। এমন একটি ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পালিত হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। দেশে টিকাদান কর্মসূচি চলছে কিন্তু চলতি জুলাইয়েই করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ। করোনায় বাংলাদেশ উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। অবস্থায় সচেতন থাকা স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ পরিপালনের বিকল্প নেই। অন্যথায় করোনা নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য ক্রমে আরো কঠিন হয়ে উঠবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎসব উদযাপন করতে হবে। যদিও আমরা দেখছি যে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলছে না, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে জনসমাগমে, পশুর হাটে যাচ্ছে। এতে সংক্রমণের মাত্রাও বাড়ছে। সাবধানতা অবলম্বন করা না হলে দেশে সংক্রমণের হারে আরো বড় ধরনের ঊর্ধ্বগতি ঘটবে বলেই অনুমেয়। তাই পশু কোরবানি উৎসব পালনে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি।

কিছুদিন আগে আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের করোনা বিপর্যস্ত অবস্থা দেখেছি। সে পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে জনসমাগম, জনসভা করা এবং দলে দলে বিভিন্ন সভায় যোগ দেয়া। দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপত্রে তুলনামূলক ভালো হওয়া সত্ত্বেও তারা রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়েছে। করোনার ডেল্টা ধরন আমাদের দেশে শনাক্ত হয়েছে এরই মধ্যে। বর্তমানে ঈদের কারণ দেখিয়ে দেশে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যানবাহন চলাচল করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ বাস, ফেরিঘাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। লঞ্চে যে পরিমাণ যাত্রী নেয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি যাত্রী নেয়া হচ্ছে। এতে করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে। এদিকে পশুর হাটগুলোয় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা হবে বলা হলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উল্টো চিত্র দৃশ্যমান। সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার বিষয়টি উঠে আসছে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক। আইসিইউ, ভেন্টিলেটর অক্সিজেনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। সংক্রমণ বাড়লে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে। কাজেই আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতা সতর্কতা বেশি প্রয়োজন।

গত বছর করোনা পরিস্থিতির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে অনলাইনভিত্তিক পশুর হাটের ওপর জোর দেয়া হয়। ভিড় এড়াতে শহরাঞ্চলের অনেকেই অনলাইন হাট থেকে কোরবানির পশু কিনেছেন। আমরা দেখেছি সরকার দ্রুত সময়ে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সীমিত আকারের কোরবানি পশুর হাটের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনের উদ্যোগে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিজ উদ্যোগে ওয়েবসাইট, অ্যাপ তৈরি ফেসবুকে পেজ খোলা হয়েছে। অনলাইন এসব প্লাটফর্মে উপজেলাভিত্তিক কসাইদের নামের তালিকা রয়েছে। ঈদের আগে ওই কসাইদের করোনা পরীক্ষা করানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে, যা ইতিবাচক। কোরবানির পশুর বাজারের ১০ শতাংশও যদি অনলাইনের মাধ্যমে কেনাকাটা হয়, তাহলেও সংক্রমণ কম হবে।

ইউরোপ, আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন মাংস প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা কসাইখানার কর্মীদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় দীর্ঘ সময় করোনাভাইরাস টিকে থাকতে পারে বলে এসব জায়গায় করোনা ছড়ায়। কয়েক বছর ধরে সিটি করপোরেশন নগরবাসীকে নির্ধারিত জায়গায় পশু কোরবানিতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। গতবার ঈদের আগেই মাইকিং করা হয়েছে। লিফলেটও বিতরণ করা হয়েছে, যাতে নগরবাসী নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানি করে। কিন্তু আমরা দেখেছি যেখানে সেখানে পশু জবাই করা হয়েছে। বছর এটা থামাতে না পারলে করোনার সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা আছে। তাছাড়া বিভাগীয় জেলা শহরগুলোয় কোরবানির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৌসুমি কসাই এসে ভিড় করেন। এবারো হয়তো এর ব্যত্যয় ঘটবে না। কসাইদের মধ্যে কে করোনা আক্রান্ত আর কে সুস্থ, তা নির্ণয় করা কঠিন। তাই যিনি কোরবানি দিচ্ছেন, তাকে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কসাই অন্যান্য সহযোগীকে মাস্ক সরবরাহ করতে হবে। পানিতে ডিটারজেন্ট পাউডার গুলিয়ে সে পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাংস কাটার সময় প্রত্যেকের নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাংস প্রক্রিয়াকারীদের জন্য একটা গাইডলাইন দিয়েছে। কোরবনির ক্ষেত্রেও সে নিয়মনীতি মানা উচিত। জনসাধারণকে বার্তাগুলো পৌঁছে দিতে হবে। তাছাড়া কোরবানির মাংস বিতরণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।

কোরবানির ঈদে একটি বড় সমস্যা হলো কাঁচা চামড়ার বেচাকেনা। কোরবানির জবাইকৃত পশুর চামড়ার ওপর আমাদের চামড়া শিল্প অনেকখানিই নির্ভরশীল। তবে এবার ঈদের পর থেকেই আবার লকডাউন চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোরবানীকৃত পশুর চামড়া নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। অবস্থায় কাঁচা চামড়া ঘিরে সংক্রমণ বৃদ্ধির একটা আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পাশাপাশি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়ছে। তাই কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এবার বাড়তি সতর্কতা জরুরি। ময়লা-আবর্জনা ঠিকমতো ব্যবস্থাপনার আওতায় না আনা গেলে এডিস মশার বিস্তার বাড়বে। ফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে পারে। তাই কোরবানির বর্জ্য দ্রুত সরিয়ে ফেলার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকে তত্পর থাকতে হবে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মানুষ নিজ নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে উদ্যোগী হলে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার কাজ অনেকটাই সহজ হবে। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, চরম শঙ্কার মধ্যে ঈদুল আজহা পালিত হচ্ছে। তাই টিকা গ্রহণসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক বাড়তি সচেতনতা সাবধানতা পালন করতে হবে প্রত্যেককেই। ঈদুল আজহা সবার জন্য নিরাপদ হোক, কামনা করি। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন