ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ার নৈপথ্যে বর্তমান প্রজন্মের ভাবনা ও করনীয়

সৈয়দা আশফাহ্‌ তোয়াহা দ্যূতি

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমাদের ফিরে দেখা দরকার রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কোথায় আছি, আমাদের ত্রুটিগুলো কোথায় হচ্ছে এবং ভুলগুলো শুধরে নিয়ে সামনে এগোতে আমাদের কী করা উচিত।  এই উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে  ইয়ুথ পলিসি ফোরাম তরুণদের নেতৃত্বে ‘ওয়াইপিএফ রোড ট্যু রিফর্মস (আরটিআর)’ - বাংলাদেশ পুনর্গঠনের যাত্রা শুরু করে গত ৩ জুলাই।   “নতুন সামাজিক চুক্তির দিকে: ভবিষ্যতের কথা”- শিরোনামে সিরিজের দ্বিতীয় পর্বের প্রাসঙ্গিকতায়  উঠে আসে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের কী ধরনের টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সেই আলোচনা । এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন খাতের পেশাজীবীরা। তারা হলেন: তৌসিফ ইশতিয়াক (ওয়াইপিএফ ফেলো: ডিজিটাল অর্থনীতি), ক্যারোল কারপিন্সকি (ওয়াইপিএফ ফেলো: বৈশ্বিক রাজনীতি),খান মোঃ শফিকুল আলম (ওয়াইপিএফ ফেলো: তথ্য কৌশল ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা), তৃষিয়া নাশতারান (ট্রান্স ডিসিপ্লিনারি ডিজাইনার ও ফোরসাইট এক্সপার্ট), শাকিল আহমেদ (ওয়াইপিএফ ফেলো: ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও মৌমিতা বসাক) - ওয়াপিএফ প্রামাণ্যতথ্য বিভাগ প্রধান।

১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের আলোচনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। অনুষ্ঠানটি শুরু করেন ওয়াপিএফের অন্যতম সদস্য: সানজিদা হোসাইন, যিনি আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশের কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন ও আন্দোলন স্মরণ করেন। ওয়াইপিএফের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, মোঃ আবির হাসান নিলয় উল্লেখ করেন যে কীভাবে ভবিষ্যত পরিকল্পনা খাতে ভবিষ্যত প্রজন্মকে মতামত দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আজকে যে রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো প্রশাসনিক ক্ষমতাধরেরা নিবেন, সেগুলোর দায় নিবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। এ বিষয়ের উপর নির্ভর করে আমাদের বর্তমান নীতিগুলো হতে হবে ভবিষ্যত বান্ধব। পরবর্তী বক্তা ওয়াপিএফ ফেলো শাকিল আহমেদের সাথে আবির হাসান তার বর্তমানে পড়া বই, রোমান ক্রাজনরিকের লেখা ‘দ্য গুড অ্যান্সেস্টর’ - নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেন। আজকে আমরা যা করছি, যে দূষণ ও দমন পীড়নের ধ্বংসাবশেষ রেখে যাচ্ছি -- এর দায় বয়ে বেড়াবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। এই প্রসঙ্গে শাকিল আহমেদ লক্ষ্য করতে বলেন ভবিষ্যতের বহুবচনতা নিয়ে। ভবিষ্যত একটি নয়, একাধিক।  তিনি আরো বলেন যে আমাদের পশ্চিমা চিন্তাধারা থেকে সরে আসতে হবে। কারণ, পশ্চিমারা নিজেরাও তাদের চিন্তাগুলোকে প্রয়োগ করেনি। 

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতগুলো সরকারি সহযোগিতা কিংবা অনুদাননির্ভরতা নিয়ে বক্তব্য রাখেন তৌসিফ ইশতিয়াক। তিনি আরো বলেন, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে দেখা যাবে, ডিজিটাল অর্থনীতি ও মূল ধারার অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য বিশেষ লক্ষনীয় নয়। তিনি কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে এর সমাধান নিয়েও আলোচনা করেন। যেমন: তিনি জানান, আমরা কিছু কিছু নতুন চিন্তা, যেমন: ই-কমার্সের সাথে অভ্যস্ত হইনি যার ফলে ডিজিটাল লেনদেনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর একটি সমাধান হতে পারে শিক্ষা, সরকারি, বেসরকারি - তিনটি খাত একত্র হয়ে কার্য সম্পাদনে এগিয়ে যেতে হবে। যেকোনো খাতকে টেকসইকরণে নতুনত্ব অবলম্বন করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের ‘ভিশন ২১’ এ উল্লেখ করা হয়েছে যে আমাদের শিক্ষাখাতকে ঢেলে সাজানো হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে তৈরি করতে পরিবর্তন-সহ হতে হবে। ডিজিটাল অর্থনীতি তৈরির পথে দু’টো কাজ করতে হবে - প্রথমটি হচ্ছে: আমাদের শিল্পখাতকে তৈরি করা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমাদের শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক তৈরি করা। তা তৈরির জন্য আমাদের প্রথমেই প্রয়োজন পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার। ক্যারোল কারপিন্সকি জানান, ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়ার সময় আমাদের বহুল প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহারের তুলনায় নতুন পদ্ধতির খোঁজ করা উচিত। তৃষিয়া নাশতারানের বক্তব্যে উঠে আসে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের ভাবনা। তিনি জানান, ধ্রুবক নির্ভর সাফল্যের সমস্যা হচ্ছে এর ফলে কিছু গৎবাঁধা আদর্শ তৈরি হয়। যা এই মডেলের বাইরের মানুষের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আমরা যখন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কিছু গুণগত তথ্যকে পরিসংখ্যান কেন্দ্রিক ধ্রুবকে বসিয়ে সাফল্য হিসাব করি, তখন আমরা আসলে সবচেয়ে কাছের, সহজলভ্য সাফল্যের গল্পটি শোনাই। যেটা আসলে কোনভাবেই পুরো চিত্র তুলে ধরে না। নারীর জন্য নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে নারী আসলে কী চায়, সে বিষয়গুলোকে মূল্যায়ন করা হয় না। আগামী দশ থেকে বিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে যদি আমরা একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে লৈঙ্গিক বৈষম্য নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দাবিরও প্রতিফলন ঘটবে। খান মুহাম্মাদ শফিকুল আলম বলেন, যত ভালোভাবে তথ্য প্রবেশ করা হবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ততটা ভালো হবে। তথ্য আসে মানসিক স্বভাব থেকে যার পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। সুতরাং, কৃত্রিম বুদ্ধ্বিমত্তা পৃথিবী দখল করে নিবে -- এই ভাবনাটা খুব একটা বাস্তববাদী না, জানান তিনি। আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তি আ্নায়নের পাশাপাশি এমন পেশাজীবী তৈরি করতে হবে যারা এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মৌমিতা বসাক জানান, গণতন্ত্র বাস্তবায়নের তাত্ত্বিক ও অনুশীলনপ্রক্রিয়া ভিন্ন। লিখিত পর্যায়ে তাত্ত্বিক আলোচনা স্পষ্ট ও বোধগম্য হলেও, অনুশীলনের ক্ষেত্রে তা একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘ভবিষ্যত পরিকল্পনা’ অন্তর্ভুক্তিকরণ শিক্ষার্থীদের এই যাত্রায় তৈরি করতে সক্ষম করবে।

এরকম কিছু সময়োপযোগী মতামতের উপর আলোকপাত করার মাধ্যমে শেষ হয় নতুন সামাজিক চুক্তির দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনার আলোচনা। এই আলোচনার পুরোটা দেখতে আগ্রহীরা চলে যেতে পারেন ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ফেসবুক পেইজে। সামনের পর্বগুলোতেও দর্শকের মতামত এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। 

লেখক : স্নাতক প্রার্থী শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি ইয়ুথ পলিসি ফোরামে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন