ক্যামেরার কবি হুমায়ূন আহমেদ

ফিচার প্রতিবেদক

হুমায়ূন আহমেদ: ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২

তিনি কবি হতে চাননি। কথা লিখেছেন হোটেল গ্রেভার ইন নামক আত্মজীবনীতে। তবে কবিতা লিখেছেন, কবি উপন্যাস লিখতে গিয়ে। কবি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, কবি উপন্যাসে কিছু কবিতা ব্যবহার করতে হয়েছে। অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি কবিতাগুলো আমার লেখা। 

কবি হতে চাননি বলে লেখক হুমায়ূন আহমেদের কবিতার সংখ্যা একেবারে কম নয়। তিনি সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে ভালো কবিতা লিখেছেন ক্যামেরায়। নির্মাণ করেছেনও বলা যায়। তার কবিতার এমন শক্তি, পাঠককে (দর্শক হবে আসলে) যেমন ঘরবন্দি করেছেন, তেমনি নামিয়েছেন রাস্তায়। 

এসব কবিতার কথা সবার জানা। এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি, প্রথম প্রহর...আরো কত কী? ১৯৮৫ সালে যখন এইসব দিনরাত্রি প্রচার হতো বিটিভিতে, ঢাকা শহর হয়ে যেত ফাঁকা। সব মানুষ ঘরে, টেলিভিশনের সামনে। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়, তার জন্য চিঠি লিখতে থাকে দর্শকরা। আবার ১৯৯৩ সালে কোথাও কেউ নেই-এর শেষ পর্ব প্রচারের সময় দর্শক নেমে এল রাস্তায়। তারা বাকের ভাইয়ের মুক্তি চায়।

নাটকের চরিত্রকে সমাজ জীবনের সঙ্গে এভাবে মিলেমিশে একাকার করে দেয়া কেবল কবির পক্ষেই সম্ভব। যিনি ক্যামেরার পেছনে বসে অমিত্রাক্ষর ছন্দে গল্প বলতে জানেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। বাঙালির ক্যামেরার কবি। তার নির্মিত নাটক তিন দশক পরেও যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনি উপভোগ্য। তার অসংখ্য সৃষ্টির ভেতর থেকে সেরা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির তালিকা তো করাই যায়

এইসব দিনরাত্রি (১৯৮৫)

হুমায়ূন আহমেদের লেখায় প্রথম ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের জীবনকাহিনী নিয়ে নির্মিত ধারাবাহিকটি সে সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। প্রধান নারী চরিত্র অর্থাৎ পরিবারের বড় বউ নীলু চরিত্রটি হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত সমাজের আদর্শ বউ। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হতো সংসারে নীলুর মতো বউ চাই ধারাবাহিকটির শিশুশিল্পী টুনি চরিত্রটিকেও দর্শকরা আপন করে নিয়েছিল।

বহুব্রীহি (১৯৮৮)

হুমায়ূন আহমেদকে নাট্যজগতের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিলেন প্রযোজক নওয়াজেশ আলী খান। তারই প্রযোজনায় বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক বহুব্রীহি সাধারণত তার উপন্যাস থেকে নাটক নির্মাণ করা হতো, তবে এটা ছিল ব্যতিক্রম। নাটকের জনপ্রিয়তার পর তিনি এটার উপন্যাস প্রকাশ করেন। দেশের নানা সমস্যা থেকে মুক্তিযুদ্ধকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে নাটকটি নির্মিত।

অয়োময় (১৯৯১)

ব্রিটিশ ভারতে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের আভিজাত্য, অহংকারসহ আরো নানা বিষয় নিয়ে নির্মিত টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ধারাবাহিক অয়োময় মির্জা সাহেব চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূরের অনবদ্য অভিনয় এবং পাখাল চরিত্রে আফজাল শরীফের অভিনয়ও দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। বিটিভিতে প্রচারিত নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন নওয়াজেশ আলী খান।

কোথাও কেউ নেই (১৯৯৩)

টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক কোথাও কেউ নেই নাটকের জনপ্রিয় চরিত্র, সর্বোপরি নাট্যাঙ্গনের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র বাকের ভাইকে নিয়ে পুরো দর্শক মহলে হইচই পড়ে গিয়েছিল। বাকের ভাইকে এতটাই আপন করে নিয়েছিলেন যে নাটকে যেন ফাঁসি না হয়, সেজন্য মিছিল বের করেছিল দর্শকরা। নাটকে মুনা চরিত্রে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয় করেছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা।

আজ রবিবার (১৯৯৬)

হুমায়ূন আহমেদের তত্কালীন বেশির ভাগ নাটক মধ্যবিত্তদের নিয়ে হলেও এটি ছিল মোটামুটি উচ্চবিত্ত পরিবারের নাটক। প্যাকেজ আকারে ধারাবাহিক নির্মাণ করেন মনির হোসেন জীবন। আনিস তিতলী-কঙ্কা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সমাদৃত হন জাহিদ হাসান শাওন-শীলা আহমেদ। এছাড়া বড় চাচার চরিত্রে আলী যাকের মতি চরিত্রে ফারুক আহমেদ বেশ সুপরিচিতি পান।

সবুজ ছায়া (১৯৯৭)

মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনবোধ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বিটিভির জন্য নির্মাণ করেন গ্রামাঞ্চলভিত্তিক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ধারাবাহিক সবুজ ছায়া ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করা হুমায়ুন ফরিদী পাগল চরিত্রে জাহিদ হাসান তখন গ্রামাঞ্চলের মানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। 

উড়ে যায় বকপক্ষী (২০০৪)

হুমায়ূন আহমেদের জীবনদর্শনভিত্তিক অন্যতম সেরা কাজ হলো ধারাবাহিক নাটক উড়ে যায় বকপক্ষী প্রথম দিকে এত আলোচনায় না এলেও ধীরে ধীরে নাটকটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। অভিনেতা ফারুক আহমেদের ক্যারিয়ারে সেরা কাজ হিসেবে বিবেচিত হয় নাটকের চরিত্র। নাটকটি প্রচার হয় এনটিভিতে।

টিভি নাটকের মতো চলচ্চিত্রেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সব চলচ্চিত্রেরই কাহিনী, চিত্রনাট্য প্রযোজনা তারই। তার নির্মিত উল্লেখযোগ্য পাঁচটি চলচ্চিত্র হলো

আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চলচ্চিত্র এটি। নির্মাণ করতে সময় লাগে চার বছর। এতে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, বিপাশা হায়াতসহ অনেকে। বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।

শ্রাবণ মেঘের দিন (২০০০)

এটি হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। নন্দিত কথাসাহিত্যিকের লেখা শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাস অবলম্বনে নূহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়। এতে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, মেহের আফরোজ শাওন, মাহফুজ আহমেদ, আনোয়ারা, মুক্তি, গোলাম মুস্তাফা, সালেহ আহমেদ, ডা. এজাজসহ অনেকে।

শ্যামল ছায়া (২০০৪)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয় চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সালে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস তথা অস্কারে সেরা বিদেশী ভাষা বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য পাঠানো হয়। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরিদী, মেহের আফরোজ শাওন, রিয়াজ, তানিয়া আহমেদ, আহমেদ রুবেলসহ অনেকে।

আমার আছে জল (২০০৮)

নিজের লেখা উপন্যাস আমার আছে জল অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। এতে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, মেহের আফরোজ শাওন, ফেরদৌস, বিদ্যা সিনহা মিম, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনমুন আহমেদ, সালেহ আহমেদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে।

ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)

এটি হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছে শিশুশিল্পী মামুন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান, মুনমুন আহমেদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, তমালিকা কর্মকার, কুদ্দুস বয়াতিসহ অনেকে।

২০১২ সালের ১৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যে যেমন সীমাহীন শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি শূন্যতার জন্ম দিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র নাট্যজগতেও।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন