ডেল্টায় বড় পরীক্ষার সামনে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন

বণিক বার্তা ডেস্ক

বেইজিংয়ে সিনোভ্যাক বায়োটেকের সদর দপ্তর ছবি: টেলিট্রেডার

বিশ্বব্যাপী মহামারী মোকাবেলাকে কঠিন করে তুলেছিল টিকার সরবরাহ সংকট। এমনই এক পরিস্থিতিতে অনেকটা ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল বেইজিং। উপহার রফতানির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহ শুরু করে চীন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় বেইজিংভিত্তিক সিনোভ্যাক বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে স্থানীয় কোম্পানিগুলো লাইসেন্সের ভিত্তিতে সিনোভ্যাকের টিকা উৎপাদনও শুরু করে। কভিডের টিকা নিয়ে চীনের সহযোগিতামূলক অবস্থানকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আখ্যা দেয় ভ্যাকসিন কূটনীতি হিসেবে। প্রকৃতপক্ষেই আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে চীনের অবস্থান শক্ত করে তোলার ক্ষেত্রে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে সিনোভ্যাকের টিকা।

তবে চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে সিনোভ্যাকের কার্যকারিতাকে বড় পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় সিনোভ্যাকের টিকা তুলনামূলক কম কার্যকর। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জনগণের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে সিনোভ্যাকের টিকা দেয়া হলেও তা ডেল্টার সংক্রমণ প্রতিরোধে তেমন কোনো শক্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না। বরং এসব দেশে এখন কভিডের তাণ্ডব মারাত্মক আকার নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো কোনো দেশ এরই মধ্যে সিনোভ্যাকের টিকা থেকে মুখ ঘুরিয়েও নিয়েছে।

মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিদ্যমান মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেশটি আর কোনো সিনোভ্যাকের টিকা সংগ্রহ করবে না। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী আধাম বাবা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার কাছে মুহূর্তে ১৬ লাখ ডোজ সিনোভ্যাকের টিকা রয়েছে। এগুলো ফুরিয়ে যাওয়ার পর মালয়েশিয়ান নাগরিকদের টিকা আর দেয়া হবে না। এরই মধ্যে মালয়েশিয়া নতুন করে ৪৫ লাখ ডোজ ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছে। শুধু এগুলো দিয়েই দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে কভিডের টিকার আওতায় আনা সম্ভব।

আধাম বাবা জানান, সিনোভ্যাকের টিকার মজুদের অর্ধেক এরই মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিতরণ করে দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোও দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই সিনোভ্যাকের টিকা আর সংগ্রহ না করার ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া। কয়েকদিন ধরেই দেশটিতে কভিডের সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ এখন থাইল্যান্ডেও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও দাবি করছে, কভিডের ধরনটির বিরুদ্ধে সিনোভ্যাকের টিকা খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, কভিড-১৯ প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয় অ্যান্টিবডি তৈরিতে টিকাটি ৯০ শতাংশ কার্যকর। ধরনের অ্যান্টিবডি করোনার আলফা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা দেখিয়েছে। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এগুলো তেমন একটা শক্তিশালী নয়। কভিডের ধরনটির বিরুদ্ধে এমআরএনএভিত্তিক টিকাগুলোই কার্যকারিতা দেখিয়েছে সবচেয়ে বেশি।

তবে থাইল্যান্ডের জন্য মুহূর্তে এমআরএনএভিত্তিক টিকা সংগ্রহ করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেও দেশটি সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের জন্য অতিরিক্ত আরো এক ডোজ টিকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এক্ষেত্রে ডেল্টা প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত বুস্টার ডোজ হিসেবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে দেশটি।

ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছে, এরই মধ্যে সিনোভ্যাকের টিকা নেয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য অতিরিক্ত আরো এক ডোজ টিকা দিতে যাচ্ছে দেশটি। এরই মধ্যে দেশটির কয়েক হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন কভিড পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে। এর আগে তুরস্ক সংযুক্ত আরব আমিরাতও (ইউএই) একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিল।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের এক গবেষণায় উঠে আসে, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা গ্রহণকারীদের দেহে অ্যান্টিবডির পরিমাণ সিনোভ্যাকের টিকা গ্রহণকারীদের তুলনায় ১০ গুণ বেশি পাওয়া গিয়েছে।

গবেষণাপত্রের মূল লেখক বেঞ্জামিন কাউলিং হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে এক সাক্ষাত্কার দিয়েছেন। সেখানে তিনি সিনোভ্যাকের টিকা গ্রহণকারীদের জন্য অতিরিক্ত বুস্টার ডোজ টিকার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বিকল্প কৌশল অনুসরণের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, ডেল্টার বিরুদ্ধে সিনোভ্যাকের টিকার দুর্বল কার্যকারিতা চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতির সফলতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। কভিডের টিকার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে যে কৌশলগত সুবিধা আদায় করে নিয়েছে চীন, তার পুরোটাই এখন বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের কাছে দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে দক্ষিণ সাগর নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বেইজিংয়ের জন্য দিনে দিনে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণে চীনেরও ভ্যাকসিন কূটনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। দেশটির বিশ্বব্যাপী অনুদান-উপহার হিসেবে দেয়া কভিড টিকার প্রায় ২৬ শতাংশই গিয়েছে অঞ্চলটিতে। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব অঞ্চলটিতে চীনকে ভূরাজনৈতিক কূটনৈতিক কৌশলগত সংকটে ফেলে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন