শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার না হওয়ায় রংপুরে বন্যা আতঙ্ক

এস এম পিয়াল, রংপুর

সংস্কারের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে রংপুর নগরীর শ্যামাসুন্দরী খাল ছবি : নিজস্ব আলোকচিত্রী

রংপুরবাসীর মনে আজও গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৃষ্ট স্মরণকালের জলাবদ্ধতার দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে। বন্যায় অনাকাঙ্ক্ষিত ভোগান্তির জন্য নগরীর মধ্য দিয়ে বহমান শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কার না হওয়াকে দায়ী করা হয়। সিটি করপোরেশনের হিসেবে ওই জলাবদ্ধতায় সড়ক এবং অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকার। তবে পানিবন্দি পরিবারের ব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষতি ধরলে আর্থিক ক্ষতি আরো অনেক বেশি। কিন্তু এখনো শ্যামাসুন্দরী খালের পরিকল্পিত সংস্কার না হওয়ায় চলতি বর্ষায় খাল পাড়ের বাসিন্দাদের দিন কাটছে বন্যা আতঙ্কে। সিটি করপোরেশনের দাবি, শ্যামাসুন্দরী খালকে কার্যকর করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। দ্রুত প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করবে।

নগরীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, রংপুরের জমিদার চৌধুরাণী শ্যামা সুন্দরী দেবীর (দেবী চৌধুরানী) পুত্র তত্কালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান (১৮৯২-৯৪) রাজা জানকীবল্লভ সেন ১৮৯০ সালে শ্যামাসুন্দরী খালটি খনন করেন। রংপুর শহরে মশার উপদ্রব ঠেকাতে খালটি খনন করা হয়। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি রংপুর নগরীর সিও বাজার এলাকার ঘাঘট নদীর উৎসমুখ থেকে শুরু হয়ে খোখসা ঘাঘটের সঙ্গে মিলেছে। ম্যালেরিয়া রোগে মৃত্যুবরণ করা রাজার প্রয়াত মাতা শ্যামাসুন্দরীর নামে এর নামকরণ করা হয়। খালটি খননের পর রংপুর পৌরসভার জলাবদ্ধতার অবসান ঘটে। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধান হয়। পরিবেশের উন্নতি ঘটে, মশার উপদ্রব কমে যায় এবং মৃত্যুর হারও কমতে থাকে।

জানা যায়, ২০০৭ থেকে ২০১৩ সালে সাত বছরে দুই দফায় কিছুটা সংস্কার হলেও পরে দীর্ঘ সময়ে শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার করা হয়নি। যদিও ২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্যামাসুন্দরী খাল পুনর্খননের কাজ হাতে নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘ সময়ে খালটি খনন না হওয়ায় এবং পানিপ্রবাহ না থাকায় খালটি অধিকাংশ স্থানে মাটি ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে গেছে। এছাড়া খালটিতে যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা অব্যাহত থাকায় খালটি বর্তমানে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, রংপুর অঞ্চলে অক্টোবরের প্রথম দিকেও বন্যা হয়। গত বছরের সেপ্টম্বরের শেষদিকে স্মরণকালের যে বৃষ্টি হয়েছিল, তা সময়মতো নিষ্কাশন না হওয়ায় পানি জনবসতিতে ঢুকে পড়ে এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে।

সমাজ পরিবর্তন উন্নয়ন ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সহিদুল ইসলাম বাবলু বলেন, শ্যামাসুন্দরী খালের জন্য দীর্ঘদিন রংপুর নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো না। সহজে পানি নিষ্কাষণ হতো। কিন্তু বর্তমানে খালটি সংস্কার না হওয়ায় খালটি পানি অপসারণের ক্ষমতা হারিয়েছে। গত বছরের বন্যার উল্লেখ করে তিনি বলেন, নগরীর অন্তত ৬৫টি পাড়া হাঁটু থেকে কোমর পানি পর্যন্ত তলিয়ে যায়। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় অন্তত এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। অনেকের হাজার হাজার টাকা মূল্যের নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে নগরবাসী সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছিল। অবিলম্বে শ্যামাসুন্দরী খাল পুনর্খননের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত খালটির সংস্কার হলে নগরবাসী দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে।

রংপুর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন বলেন, গত বছরের বন্যায় সিটি করপোরেশনের সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকার। তিনি স্বীকার করেন শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার না হওয়ায় গত বছরের বন্যায় জনদুর্ভোগ প্রকট হয়েছিল। তাই শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এরই মধ্যে ঢাকার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিকোন ডিজাইনের সঙ্গে ৮০ লাখ টাকায় চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমান মেয়রের আমলে বন্যায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মাস্টার প্লানের অংশ হিসেবে ১০০ কিলোমিটার নতুন ড্রেন নির্মাণসহ পাঁচটি ব্রিজ সংস্কার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, শ্যামাসুন্দরী খাল পরিকল্পিতভাবে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দ্রুত শ্যামাসুন্দরী খালের কেমন সংস্কার প্রয়োজন তা জানতে নগরীর বিশিষ্টজনদের নিয়ে আলোচনা সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পরে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করবে ঢাকার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিকোন ডিজাইন। এছাড়া খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য দ্রুত জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করবে সিটি করপোরেশন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন