কভিডের এক বছরে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক এক জরিপের তথ্য বলছে, গত এক বছরে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মোট বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশেরও বেশি। অর্থমূল্যে এর পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। কভিডকালে ওষুধের এ বর্ধিত চাহিদার সুফল সবচেয়ে বেশি পেয়েছে বড় কোম্পানিগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটির বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশও ছাড়িয়েছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরায়ণের চাপ ও পরিবেশদূষণের কারণে মানুষের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য খাতে জনসাধারণেরও ব্যয় বাড়ছে। এছাড়া দেশের অর্থনীতি ও জনসংখ্যার আকার বাড়ছে। এ দুয়ের প্রভাবেই যেকোনো পণ্য বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা। এর সঙ্গে ওষুধ ও সাপ্লিমেন্টের চাহিদায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে কভিড-১৯ মহামারী। এসব কিছু মিলিয়েই ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে।
ওষুধ বিক্রি ও ধরন নিয়ে নিয়মিত জরিপ চালায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্লিনিক্যাল গবেষণার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ। প্রতি প্রান্তিকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওষুধের বিক্রির তথ্য সংকলন ও পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি। সংস্থাটির হিসাবে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে দেশের বাজারে ওষুধ বিক্রি হয়েছে ২৭ হাজার ২৬২ কোটি টাকার। এর আগে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিক্রির পরিমাণ পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। এ সময়সীমা বিবেচনায় ওষুধ বিক্রিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ২১ শতাংশে। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশে।
ওষুধ কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, কভিডের কারণে গত এক বছরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিকারী সাপ্লিমেন্টের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ভোক্তা পর্যায়ে ভিটামিন সি ও ডি সাপ্লিমেন্টের চাহিদায় বড় ধরনের ঊর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছে। ফলে কোম্পানিগুলোও বাজারে এসব সাপ্লিমেন্টের সরবরাহ ও বিক্রি বাড়িয়েছে। তবে ওষুধ কোম্পানিগুলোর কভিডকেন্দ্রিক বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি শুধু সাপ্লিমেন্টে আসেনি। এ সময় রেমডিসিভির, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেকটিন জাতীয় ওষুধ বিক্রিও বেড়েছে।
এছাড়া কোম্পানিগুলোর বিক্রয় ও বিপণন ব্যবস্থাপনাও এ প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো চিকিৎসকদের আস্থা ধরে রাখার পাশাপাশি কভিডকেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগ দিয়েছে। এছাড়া মহামারীর প্রভাবে বেশকিছু ওষুধের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। কোম্পানিগুলো সে চাহিদা সঠিকভাবে মেটাতে সক্ষম হয়েছে। ফলে মহামারীর মধ্যেও ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ নিজ সক্ষমতা অনুযায়ী সরবরাহ ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বণিক বার্তাকে বলেন, ওষুধ খাতের সম্ভাবনা ব্যাপক। কভিডের সময়েও ওষুধ খাত কাজ করেছে। জনগণকে ওষুধ পৌঁছাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এ কাজে সফলও হয়েছে। চলমান সময়ে ওষুধ শিল্পের বড় অবদান ছিল। যেসব ওষুধ অনেক দেশে পাওয়া যায়নি সেগুলো বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। মানুষ সেগুলো পেয়ে লাভবান হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয় আমাদের ওষুধে পুরো লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মিয়ানমারসহ পৃথিবীর বহু দেশ উপকৃত হয়েছে।
আইকিউভিআইএর হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট ওষুধের প্রায় ৭১ শতাংশই বিক্রি করে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠান। উল্লিখিত এক বছরে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে ছিল হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ওষুধ বিক্রি করেছে ১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকার। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তবে এ সময় মোট বিক্রির দিক থেকে চতুর্থ অবস্থানে ছিল প্রতিষ্ঠানটি।
বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। এই এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। বিক্রি বেড়েছে ২৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। তবে মোট বিক্রির তালিকায় বেক্সিমকোর অবস্থান তৃতীয়।
দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে গত বছর সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। যদিও বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি ছিল তৃতীয় অবস্থানে। এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ৭১৫ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। বিক্রয় প্রবৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে চতুর্থ অবস্থানে ছিল এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। করোনার এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি বেড়েছে ২২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। তবে এ সময় মোট বিক্রির দিক থেকে এসকায়েফের অবস্থান ছিল সপ্তম।
গত মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে পঞ্চম অবস্থানে ছিল অপসোনিন। কোম্পানিটির ওষুধ বিক্রিতে এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মোট বিক্রির পরিমাণ ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এদিক থেকেও কোম্পানিটির অবস্থান ছিল পঞ্চম।
বিক্রিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ষষ্ঠ স্থানে ছিল ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
এছাড়া ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিক্রয় সম্প্রসারণের দিক থেকে সপ্তম ছিল রেনাটা। অষ্টম অ্যারিস্টোফার্মার প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ বিক্রি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে নবম স্থানে ছিল এসিআই। এ তালিকায় দশম ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের বিক্রি বেড়েছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
খাতটির বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমোদিত ওষুধগুলো বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৈরি করে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে কোম্পানিগুলো। উৎপাদনের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের জনবলের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে বাজারে পরিকল্পিতভাবে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে মহামারীকালেও ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়েনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মার্কেটিং ডিরেক্টর আহমেদ কামরুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, গত এক বছরে কভিডের প্রভাবে বাজারের যে ভিন্নতা ছিল তার প্রতিফলন দেখা গেছে বিপণন ও প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডে। বিশেষ করে চিকিৎসকের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের বিষয়গুলো ডিজিটাল ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে করতে হয়েছে। এক বছরে ওষুধ বিক্রিতে প্রবৃদ্ধির যে হার, তা অনেক দিন পরে হয়েছে। এ পর্যায়ের প্রবৃদ্ধি এর আগে হয়েছে চার-পাঁচ বছর আগে। নিকট অতীতে এত ভালো প্রবৃদ্ধি আমরা দেখিনি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি করতে হয়েছে মানুষকে। ব্যাপক প্রবৃদ্ধির জন্য কভিডের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা সমানভাবে কাজে লেগেছে।
তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিকভাবেই কভিডকেন্দ্রিক ওষুধের চাহিদা বেশি ছিল, যা যাচাই করে ওই পণ্যগুলো বেশি তৈরি করার মতো বিষয়গুলোয় আমাদের দক্ষতাও ভালো ছিল। এছাড়া দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও এখন বাড়ছে। ১০ বছর আগেও মানুষ অর্থাভাবে যে রোগের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেত না, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় সে রোগের চিকিৎসার জন্য মানুষ এখন নিজ থেকেই চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। কিছু চিকিৎসার জন্য আগে আমরা দেশের বাইরেও যেতাম, এখন মানসম্পন্ন হাসপাতাল হওয়ায় সেসব চিকিৎসা দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। এই সবকিছুই ওষুধের বাজার বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে।