ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

অনুমোদিত আসন ৪০ ভর্তি হয়েছে ৯০০

সাইফ সুজন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি করার আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) থেকে অনুমোদন নেয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রোগ্রামের অনুমোদন দেয়ার সময় শিক্ষক সংখ্যা ল্যাব সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয় কমিশন। যদিও ইউজিসি নির্ধারিত সেই শর্ত ভঙ্গ করে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে সেমিস্টারপ্রতি ভর্তির আসন সংখ্যা ৪০। যদিও গত শিক্ষাবর্ষে শুধু এক সেমিস্টারেই বিভাগটিতে ৯০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিকে বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন দেয় ইউজিসি। অনুমোদনকালে প্রোগ্রামটিতে সেমিস্টারপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দিয়েছিল ইউজিসি। প্রোগ্রামটির কার্যক্রম শুরুর পর থেকে প্রতি সেমিস্টারেই নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটানোর অভিযোগ রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে।

কয়েক বছর আগে ইউজিসির এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি সেমিস্টারে ল্যাব-সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম বা কোর্সে সর্বোচ্চ ৫০ জন এবং অন্যান্য প্রোগ্রাম বা কোর্সের জন্য প্রতি সেমিস্টারে সর্বোচ্চ ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে। কমিশনের অনুমোদন ছাড়া আসন সংখ্যা কোনোভাবেই বাড়ানো যাবে না।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তিসংক্রান্ত পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, গত শিক্ষাবর্ষে শুধু স্প্রিং সেমিস্টারেই বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে ৯০০-এর বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি। শুধু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, অধিকাংশ প্রোগ্রামের ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে অনুমোদিত আসনের কয়েক গুণ। এর মধ্যে গত শিক্ষাবর্ষের স্প্রিংয়ে বিএসসি ইন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (ইইই) ৫৮৪ জন, বিএসসি ইন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ২৩৯, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ১৪৩ ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (বিবিএ) ৯৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি। এভাবে প্রতি শিক্ষাবর্ষের তিন সেমিস্টারেই অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি।

আসনের অতিরিক্ত ভর্তি করার বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে বেআইনি অবৈধ বলছে উচ্চশিক্ষার তদারককারী সংস্থা ইউজিসি। প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য . বিশ্বজিৎ চন্দ বণিক বার্তাকে বলেন, অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। অতিরিক্ত ভর্তি করা এসব শিক্ষার্থীর সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অভিযোগের প্রমাণ পেলে বিষয়ে কমিশন অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।

তিনি আরো বলেন, প্রোগ্রাম অনুমোদনের প্রস্তাব এলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদানের সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য ইউজিসির একটি পরিদর্শক দল আবেদনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অনুসন্ধান চালায়। পরিদর্শনে পাওয়া শিক্ষক অবকাঠামো-বিষয়ক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী আসন সংখ্যা ঠিক করে দেয়া হয়। আর সাধারণভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই সর্বোচ্চ আসন ঠিক করে দেয়া রয়েছে। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই এর বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি ডিগ্রি দেয়ার অধিকার নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির লক্ষ্য থাকে পলিটেকনিক থেকে পাস করা ডিপ্লোমা সনদধারীদের ভর্তি করার। ইউজিসির অনুমোদন না থাকলেও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের টানতে চার বছরের বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিকে তিন বছরে রূপান্তর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তিন বছরে ডিগ্রি নিতে শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। গত শিক্ষাবর্ষের স্প্রিংয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়া ৯০৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৬০ জনই ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। একইভাবে ইইই, সিএসই টেক্সটাইলে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ডিপ্লোমা করে আসা।

ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, ইউজিসি থেকে অনুমোদন দেয়া বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংকে দুটি নাম দিয়ে আলাদা দুটি প্রোগ্রামে রূপ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এগুলো হলো বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (ডিপ্লোমা) বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (রেগুলার) অথচ কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ডিপ্লোমা, বিশেষ কিংবা সন্ধ্যাকালীন হিসেবে অনুমোদিত প্রোগ্রামের নামের সঙ্গে এমন কোনো বিষয় যোগ করে ভর্তি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। যদিও প্রোগ্রামটির কার্যক্রম চালুর শুরু থেকেই নির্দেশনার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি সূত্র জানায়, ক্রেডিট টিউশন ফির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়ে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করা হয়। এমনকি ক্লাস না করেও শুধু পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমেও সনদ দেয়ার প্রতিশ্রুতির অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে।

প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, এখানে শিক্ষার ন্যূনতম কোনো পরিবেশ নেই। নামমাত্র ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য অর্থ উপার্জন, আর শিক্ষার্থীর প্রয়োজন সনদ। সব মিলিয়ে সনদের রমরমা ব্যবসা চলছে। এখন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের ফলে সে বাণিজ্য আরো সহজ হয়েছে। যেহেতু নামমাত্র শিক্ষা, তাই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখানে অনেক সহকারী কিংবা সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষক রয়েছেন, যারা অন্য জায়গায় প্রভাষকের চাকরিও পাবেন না।

ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আল ইমদাদ গত শিক্ষাবর্ষের স্প্রিংয়ে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনার সময় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও ওই সেমিস্টারে ৯০০ শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম ভেঙে ভর্তি নেয়ার তো কথা না। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় এখন বন্ধ, খুললে বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। এখন এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

তবে আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির প্রমাণ মেলে বিশ্ববিদ্যালয়টির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের বক্তব্যেও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়ার মানে এই নয় যে গুণগত শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না। আমরা শিক্ষার্থী সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়েছি। ল্যাব গড়ে তুলেছি। আর প্রোগ্রামে তো বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। ডে, নাইট, ছুটির দিন, রেগুলার ধরনের বিভিন্ন শাখা রয়েছে। সে আলোকে ভর্তি করা হয়। তবে করোনার কারণে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এখন প্রতি সেমিস্টারে দুইশর মতো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়।

দেশের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির ক্ষেত্রে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), রাজশাহী প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) খুলনা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে রুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ২৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়, যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১৯৫ জন কুয়েটে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এমনকি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিগণিত প্রতিষ্ঠান নর্থ-সাউথেও প্রতি সেমিস্টারে সর্বোচ্চ ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।

ইউজিসির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক . মুহাম্মদ আলমগীর। ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে কুয়েটের সাবেক উপাচার্য বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিস্টারে ৯০০ শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয় যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এটি বিশ্বের মধ্যে নজিরবিহীন ঘটনা হবে। বিশ্বের কোথাও এমনটি নেই। দেশে বুয়েট, রুয়েট কুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানেও দুই-আড়াইশর বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় না। আমি মনে করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে শিক্ষক ল্যাব সুবিধা রয়েছে, তা দিয়ে সেমিস্টারপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা যেতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন