সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের অস্বাভাবিক লোকসান!

মেহেদী হাসান রাহাত

দেশের পুঁজিবাজারে ২০১৩ সালে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয় ওষুধ খাতের কোম্পানি সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। আইপিওতে আসার আগে কোম্পানি আর্থিক ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো দেখালেও পুঁজিবাজারে আসার পর থেকেই এর পারফরম্যান্স গ্রাফ নিম্নমুখী। সর্বশেষ ২০১৯-২০ হিসাব বছরে প্রায় ১১১ কোটি টাকার লোকসান দেখিয়েছে কোম্পানিটি। মূলত মজুদ পণ্য বকেয়া অর্থ রাইট অফ করার কারণে লোকসান হয়েছে। অন্যদিকে রাইট অফ করা মজুদ পণ্য বকেয়া অর্থের যথার্থতা নিশ্চিত করতে পারেননি কোম্পানিটির নিরীক্ষক। সব মিলিয়ে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের বড় অংকের লোকসান অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইপিওর আগে ২০১১-১২ হিসাব বছরে ২৫ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে কোটি ৮০ লাখ টাকা কর-পরবর্তী নিট মুনাফা করে কোম্পানিটি। এর পরের ২০১২-১৩ হিসাব বছরে যা বেড়ে বিক্রি ৪২ কোটি এবং মুনাফা কোটি ৭৮ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৩ সালে আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ১৪ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করে। আইপিওতে আসার পর ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১৫ শতাংশ স্টক শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। একই বছরে কোম্পানিটির বিক্রি ৬৫ কোটি টাকা এবং নিট মুনাফা ১৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর পরের ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ৬৬ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে ১৪ কোটি টাকা মুনাফা দেখায় কোম্পানিটি। বছর কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়।

আইপিওতে আসার দুই বছর পর ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে কোম্পানিটির বিক্রি কমে ৪১ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয় কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে কোম্পানিটির বিক্রি মুনাফা কিছুটা বেড়ে যথাক্রমে ৪৫ কোটি ১০ কোটি ৯০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। হিসাব বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়।

২০১৭-১৮ হিসাব বছরে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের বিক্রি কমে ৩১ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। পাশাপাশি কোম্পানিটির নিট মুনাফাও কমে দাঁড়ায় কোটি টাকায়। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ৩০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বিক্রির বিপরীতে নিট মুনাফা দাঁড়ায় কোটি ৭০ লাখ টাকায়। বছর কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের মাত্র শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়।

সর্বশেষ ২০১৯-২০ হিসাব বছরে এসে কোম্পানিটির বিক্রি কমে ১৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর বিপরীতে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী লোকসান হয় ১১০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটি ১৪ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে ৬২ কোটি ৯২ লাখ টাকা উৎপাদন ব্যয় দেখায়। আর সময়ে প্রশাসনিক ব্যয় দেখানো হয় ৫৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মূলত সময়ে কোম্পানির পর্ষদের সিদ্ধান্তে ৪৮ কোটি টাকার মজুদ পণ্য ৫৮ কোটি টাকার বকেয়া অর্থ রাইট অফ বা হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয়।

অবশ্য কোম্পানিটির মজুদ পণ্য বকেয়া অর্থের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন নিরীক্ষক। ২০১৯-২০ হিসাব বছরে আর্থিক প্রতিবেদনে বিষয়ে কোয়ালিফায়েড মতামত দিয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস। নিরীক্ষকের কাছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এসব মজুদ পণ্য নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে জানায়। যদিও এর বিপরীতে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি কোম্পানি। একইভাবে রাইট অফ করা বকেয়া অর্থের সমর্থনে কোনো দলিলাদিও কোম্পানির পক্ষ থেকে নিরীক্ষককে দেয়া হয়নি।

এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনসুর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের আর্থিক ব্যবসায়িক অধোগতির বিষয়টি নজরে রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেরও (বিএসইসি) এরই মধ্যে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কমিশনের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। যদিও কোম্পানির বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেনি কমিশন। বিএসইসি মনে করছে আর্থিক প্রতিবেদনে মিথ্যা অতিরঞ্জিত তথ্য দেয়ার মাধ্যমে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এজন্য কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষা পর্ষদ পুনর্গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করছে কমিশন।

বিষয়ে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক . শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের বিষয়টি আমাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। প্রয়োজন হলে আমরা পর্ষদ পুনর্গঠন করে এর আর্থিক ব্যবসায়িক অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করব। যদি তাতেও কাজ না হয় তাহলে অবসায়নের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেব না।

১৯৮০ সালে কার্যক্রমে আসা সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল, অ্যান্টি ইনফেকটিভ, ভিটামিন, সর্দি-কাশি অ্যালার্জি, প্যারাসিটামল, চর্মরোগ, ডায়াবেটিসের ওষুধ এবং খাবার স্যালাইন তৈরি করে। কোম্পানিটির ব্যবসায়িক আর্থিক পারফরম্যান্স নিম্নমুখী থাকলেও পুঁজিবাজারে যেসব স্বল্প মূলধনি কোম্পানি শেয়ারদর বাড়ার কারণে আলোচনায় থাকে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস তার অন্যতম।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন