সত্যজিৎ বনাম বালার ‘স্পটলাইট’

হ্যাশট্যাগ হাউ ফার ক্যান ইউ গো

মনিরা শরমিন

‘স্পটলাইট’-এর দৃশ্য

সত্যজিৎ রায় অনন্য। কিন্তু কেন? শুধু কি তার ভারি ভারি চলচ্চিত্র, লেখাপত্র আর অস্কারের জন্য? আমার মনে হয় না। সত্যজিৎকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমাদের শৈশবের জন্য। ছোটবেলায় থোড়াই বুঝতাম যে তিনি অস্কারপ্রাপ্ত  চলচ্চিত্র নির্মাতা। মূলত আমরা যারা বাঙালি, তাদের রায় পরিবারকে (উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার এবং সত্যজিৎভালো লাগা শুরু হয় সংস্কৃতি-ভাষা নিয়ে সচেতন হওয়ার অনেক আগেই। আপন মনে ----লর ইলাস্ট্রেশনে কাঠপেন্সিল দিয়ে রঙ করতে করতে। এরপর আরেকটু বড় হলে আমাদের মনোজগতে ঠাঁই নেয় ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুর দারুণ সব ইলাস্ট্রেশনের রোমহর্ষক বইগুলো। আর অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত পরিবারের সাদা-কালো টিভিতে একবারও যদি ভারতের দূরদর্শন ধরা যেত, সেখানে দেখা মিলত গুপী গাইন-বাঘা বাইন আর তাদের সেই মিষ্টি ভূতকে। তারপর আপনি যত বড় হতে থাকবেন, আপনার সত্যজিৎও ততই বড় হবে। সমাজতন্ত্র, সামন্তবাদ, ধর্ম, নারীবাদ, দারিদ্র্য, শ্রেণী সব মিলিয়ে একটা জটিল জগতে আপনি হারিয়ে যেতে থাকবেন।

সত্যজিতের জন্মশতবার্ষিকীতে তারই গল্প অবলম্বনে নেটফ্লিক্সের রে সমগ্রর তিন তরুণ নির্মাতার বানানো চারটি শর্ট ফিল্ম দেখার আগে তাই মন একটু দোলাচলেই ছিল। সমগ্রর প্রথম দুটো ছবি সৃজিত মুখার্জির ফরগেট মি নট এবং বহুরূপিয়া, অভিষেক চুবের হাঙ্গামা হ্যায় কিউ বারপা এবং ভাসান বালার স্পটলাইট। যেগুলো সত্যজিৎ রায়ের  বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম, বহুরূপী, বারীণ ভৌমিকের ব্যারাম আর স্পটলাইট-এর অ্যাডাপটেশন। প্রত্যেকটি ছবিই এখানে নিজ নিজ চরিত্র নিয়ে হাজির, যার উপস্থাপনে মূল গল্প থেকে বিস্তর ফারাক। আমাকে টেনেছে সমগ্রের শেষের দুটো ছবি, বিশেষ করে ভাসান বালার স্পটলাইট।

গেল শতকের ষাটের দশকে সত্যজিতের লেখা স্পটলাইটের একরত্তি নির্যাস ছাড়া আর কোনো কিছুতেই মূল গল্পের ছোঁয়া নেই চলচ্চিত্রটিতে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় সিনেমার আনাচে-কানাচে সব জায়গায় ছড়িয়ে আছেন সত্যজিৎ। ছবিটা যে ইম্প্রোভাইজড, সেটা চলচ্চিত্রে টাইটেল বোর্ডেই নির্মাতা পরিষ্কার করেছেন। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে ভারতের ধর্মীয় উন্মাদনার যে ভয়ংকর উত্থান, তারই পাটাতনে দাঁড়িয়ে একজন জনপ্রিয় কিন্তু অদক্ষ এবং অতৃপ্ত অভিনয় শিল্পীর ইনসিকিউরিটির গল্প এটি। চলচ্চিত্রটির বাইনারির দুই প্রান্তে রয়েছে ফিল্মস্টার বিক্রম আরোরা ভিক (হর্ষবর্ধন কাপুর) ধর্মীয় গুরু দিদি (রাধিকা মদন) বর্তমান চরিত্র দুটি মূলত রায় নির্মিত অন্য দুটি চলচ্চিত্র দেবী (১৯৬০) নায়কের (১৯৬৬) মূল দুটি চরিত্রের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। মজার বিষয়, ধর্মীয় নেতাদের বহুল আলোচিত আইডেনটিটি মা বা গুরু মা থেকে পরিবর্তন করে চলচ্চিত্রে দিদি পরিচিতি ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। আরো মজার বিষয়, দিদি চরিত্রটিকে প্রথম থেকেই ধর্মের খোলসে আটকে রাখলেও শেষ পর্যন্ত তার সুপার পাওয়ারের ধারণাকে অত্যন্ত কৌশলে ওপেন এন্ডেড করে রেখেছেন নির্মাতা।

সত্যজিতের লেখা গল্পে ফিল্মস্টার চরিত্রটি অন্যের বয়ানে খুব দূরবর্তীভাবে পাঠ করা যায় কিন্তু বালার চলচ্চিত্রে পুরো ন্যারেটিভ হাজির হয় ফিল্মস্টারেরই দৃষ্টিকোণ থেকে।

ছবিটিতে মূল দুটি চরিত্রই অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং খ্যাতির বিড়ম্বনায় আটকে পড়া মানুষ। পাশাপাশি তারা এই বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসতে উন্মুখ। এর প্রকাশ দেখি বিক্রমের গতানুগতিক চরিত্র চিত্রায়ণ থেকে বেরিয়ে ভালো অভিনেতা হওয়ার এবং দিদির নিজে থেকেই দলের লোকদের মাদক নারী ব্যবসার জন্য পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। শেষ দৃশ্যে বন্দিদশা ভাঙতে দিদি এবং ফিল্মস্টার পরস্পরের সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হন, যা অবশ্যই মূল গল্পে ছিল না। 

  চলচ্চিত্রে প্রথম থেকে দুটো মেটাফোর খুব প্রবল। প্রথমত, বাইনারির দুই প্রান্তে দাঁড়ানো মূল প্রটাগনিস্টদের লড়াইটা দৃষ্টি বা চোখকে কেন্দ্র করে হতে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, লড়াইয়ের মধ্যে ম্যাজিক অবশ্যম্ভাবী, যেখানে সত্যজিতের ভূতের রাজা হতে যাচ্ছে মূল ক্রীড়নক। কারণ চলচ্চিত্রটিতে একটু পরপর দোকানে, রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, পোস্টারে, ব্যানারে, গহনায় চোখ-এর আইকন এবং রেফারেন্স যেমন হাজির হতে দেখি, ঠিক তেমনি টি-শার্টে, ক্ল্যাপার বোর্ডে এমনকি ঘটনার ক্লাইমেক্সে বিক্রম চরম হতাশায় মধ্যরাতে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমরা ঘরের টেবিলে ভূতের রাজার একটি আইকন দেখতে পাই।

এছাড়া পপুলার বা পপ কালচার থেকে আরো অনেক রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে ছবিজুড়ে। যেমন ডিউক অ্যান্ড গনজো ব্যান্ডের টি-শার্ট। মিউজিক ব্যান্ডটির খুব জনপ্রিয় দুটি ট্র্যাকের নামই সাইকিডেলিক সুররিয়াল। ফলে টি-শার্ট পরার রাতেই আমরা ভিককে সাইকিডেলিক হিসেবে আবিষ্কার করি। তার হ্যালুসিনেশন হতে শুরু করে।

চলচ্চিত্রে লিঞ্চিয়ান নাইটমেয়ার বলে একটি কথা ভিকের সঙ্গে তার বান্ধবী আনুয়ার (আকাঙ্ক্ষা রঞ্জন কাপুর) কথোপকথনের সময় শুনতে পাই।  আমেরিকান ফিল্মমেকার ডেভিড লিঞ্চের চলচ্চিত্রের সঙ্গে হয়তো আমরা অনেকেই পরিচিত। তার ১০টি ফিচার ফিল্মের প্রায় প্রত্যেকটিতেই তিনি ভয়ংকর সব স্বপ্নদৃশ্য ব্যবহার করেছেন। তারই নামানুসারে চলচ্চিত্রজগতে লিঞ্চিয়ান নাইটমেয়ার শব্দ যুগল ব্যবহূত হয়। ভিকের জন্য সেই রাতটা ছিল এমনই দুঃস্বপ্নের মতো। আনুয়া তাকে ছেড়ে যায়, ছবির প্রডিউসার ফোন করে চলচ্চিত্র থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয় এবং তার দৃষ্টির জাদুকে ছাড়িয়ে দিদির দৃষ্টির জাদুতে ভক্তকুল আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়া ভিকের ম্যানেজারের নাম রবি ঘোষ এবং মায়ের বর পাওয়ার সময় বলা সাতটি চলচ্চিত্রের নাম মূলত সত্যজিৎ রায়ের প্রতি ভাসান বালার ট্রিবিউট।

গল্পটি বাঁক নেয়, যখন সত্যজিৎ নির্মিত গুপী গাইন বাঘা বাইনের (১৯৬৮) সেই বিখ্যাত ভূতের রাজার আদলে ভিকের মা এসে হাজির হয় এবং ভিক বরপ্রাপ্ত হয়। এর পরই চলচ্চিত্র সুররিয়াল জগতে প্রবেশ করে। ম্যাজিক হতে শুরু করে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল গুপী-বাঘার জীবনে। ভূতের বর পাওয়ার পর আমূল পাল্টে গিয়েছিল তাদের জীবন। তেমনিই এখানেও ঘটনার পরেই দিদিকে অ্যারেস্ট করতে হোটেলে পুলিশ চলে আসে এবং আরো নাটকীয়ভাবে ভিক দিদির অনুরক্ত হয় এবং জানতে পারে, দিদি নিজেও তার চলচ্চিত্রের ভক্ত। তারা দুজন দুজনকে সাহায্য করে এবং দুজনে একসঙ্গে নিজ নিজ মানসিক বন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভ করে।

প্রায় পুরোটাই ইনডোর শুটিং হওয়ায় সিনেমাটোগ্রাফির মুনশিয়ানা তেমন দেখা যায়নি ছবিটিতে। তবে আলোর ব্যবহারে সৃজনশীলতার ছাপ ছিল। একাধিক মানসিক দশা বোঝাতে একই সিনে দুই রঙের আলোর ব্যবহার ছিল অনন্য। বিপদ বোঝাতে লাল, হ্যালুসিনেশনের রাত বোঝাতে নীল আর ক্লাইমেক্সে কমলা আলোর ব্যবহারও ভালো ছিল। চলচ্চিত্রের সবচেয়ে দক্ষতার জায়গা হলো এর আর্ট ডিজাইন এবং চিহ্ন বা সিম্বলিজমের ব্যবহার। আর দুর্বলতম জায়গা হলো অভিনয়। অভিনেতা হিসেবে চন্দন রায় স্যানাল এবং রাধিকা মাদান ছাড়া আর কাউকেই আশেপাশে পাওয়া যায় না। যদিও ভাসান বালা নিজেও ছবিতে কাজ করেছেন ডিরেক্টরের চরিত্রে।

সব শেষে বলতে পারি, অ্যাডাপটেশন বা সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আপনাকে হুবহু মূল গল্পের মতোই বানাতে হবে তা কিন্তু নয়। সেটা স্পটলাইটের ক্ষেত্রেও সত্য। রায় তার ১২ গল্পের সিরিজ, ভূতের প্রেজেন্টেশন, গুপী-বাঘা ত্রয়ী কিংবা ফেলুদা অথবা শঙ্কু সিরিজ সবটাই প্রায় নারী বিবর্জিত রেখেছিলেন। নবীন নির্মাতারা সেই জায়গা থেকে এখন বেরিয়ে এসে নারীকে উপস্থাপন করেছেন এবং কয়েকটি জায়গায় অবশ্যই পুরুষের সমান্তরালভাবেই। এটা অবশ্যই উত্তরণ। বিশেষ করে স্পটলাইট চলচ্চিত্রটি দিদি প্রপঞ্চকেন্দ্রিক সাইকি নিয়েই আবর্তিত হয়েছে। ফলে স্পটলাইট চলচ্চিত্রের ভাষায় যদি বলি, হ্যাশট্যাগ হাউ ফার ক্যান ইউ গো, তাহলে নিসংকোচে বলা যায় ২০১২ সালে কান চলচ্চিত্রে মনোনয়নপ্রাপ্ত নির্মাতা ভাসান বালা রে-কে নিয়ে আদতে বহুদূরই গেছেন।

 

লেখকচলচ্চিত্র সমালোচক  শিক্ষকজার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া কমিউনিকেশন বিভাগগ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ                                                                          [email protected] 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন