কনটেইনার ও জাহাজ সংকটে পোশাকের রফতানি আদেশ বাতিলের শঙ্কা

জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়

চলমান মহামারীতে কঠিন সময় পার করছে রফতানি আয়ের প্রধান ক্ষেত্র পোশাক খাত। প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে উঠেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের অভিঘাত মোকাবেলা করছে এখন খাতটি। এর মধ্যে অবশ্য আগের চেয়ে ক্রয়াদেশ বেড়েছে। রফতানি আয়েও ইতিবাচক ধারা দৃশ্যমান। কিন্তু নতুন সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে রফতানি পণ্য পরিবহনে কনটেইনার জাহাজ সংকট। এতে পোশাক পণ্য যথাসময়ে জাহাজীকরণ ক্রেতাদের কাছে পাঠানো যাচ্ছে না বলে খবর মিলছে। অবস্থায় অনেকের রফতানি আদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা করছেন পোশাক মালিকরা। কাজেই দ্রুত সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ কাম্য।

রফতানি পণ্য পরিবহনে বিরাজমান সমস্যার সঙ্গে কতগুলো বিষয় যুক্ত। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বহিস্থ উভয় ফ্যাক্টরই দায়ী। সিঙ্গাপুর, কলম্বো মালয়েশিয়ার মতো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোয় আগে থেকে সৃষ্ট অচলাবস্থার প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এখানে রফতানি পণ্য পরিবহনে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ জট। এছাড়া কনটেইনারের সংকট, বড় জাহাজ কম আসা, আমদানির সঙ্গে ভারসাম্য না থাকার নেতিবাচক প্রভাবও আছে রফতানি বাণিজ্যে। সাধারণত যেসব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে, সেগুলোই আবার পণ্য নিয়ে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে যায়। কিন্তু এখন আমদানি হচ্ছে কম। খুব জরুরি পণ্য ছাড়া আমদানি করছেন না আমদানিকারকরা। বিপরীতে রফতানি হচ্ছে বেশি। সংগত কারণে বাইরে থেকে আসা জাহাজের গতি কম। এতে জাহাজের সংকট দেখা দিয়েছে। এমনকি যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রগামী চাহিদা অনুযায়ী বুকিং না মেলার তথ্যও উঠে এসেছে বণিক বার্তার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে। ফলে নির্ধারিত সময়ে পণ্য পাঠাতে পারছেন না রফতানিকারকরা। প্রেক্ষাপটে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি রফতানি আদেশ বাতিলের যে আশঙ্কা করছেন, তা সংগত।

রফতানি কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেসরকারি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোগুলোয় (আইসিডি) পণ্যের বিরাট স্তূপ তৈরি হয়েছে। তথ্যমতে, বর্তমানে ১৮টি ডিপোর ধারণক্ষমতা আট হাজার টিইইউস কনটেইনার। সেখানে ১৪ হাজার টিইইউস রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার আটকে আছে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে ডিপোগুলোয় গড়ে ছয় থেকে সাত হাজার টিইইউস রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার থাকে। ধারণক্ষমতা না থাকায় এখন ডিপোগুলোর ভেতরে বাইরে দীর্ঘ জট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে খালি কনটেইনার যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি সময়মতো জাহাজীকরণ সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণত আইসিডি থেকে জাহাজে তোলার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো কনটেইনার পাঠাতে দু-তিনদিন সময় লাগে। বর্তমানে সেটি ১০ দিন বা তার বেশি লাগছে। এছাড়া পুরো রফতানি প্রক্রিয়া স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন বেশি সময় লাগছে বিদেশী ক্রেতাদের হাতে পণ্য বুঝিয়ে দিতে। এতে কারখানাগুলো নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে। আবার সঠিক সময়ে সরবরাহ করতে না পারায় কারখানার উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি, ক্রেতা উৎপাদকের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে; রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যা ভীষণভাবে ক্ষতিকর। সুতরাং উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে ন্যূনতম শৈথিল্য কাম্য নয়।

এরই মধ্যে পোশাক মালিকরা চলমান সংকট নিরসনে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তারা বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে খালি কনটেইনার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ, কনটেইনার ফিডার ভেসেল বার্থিং সংখ্যা বাড়ানো, অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও নতুন কোম্পানিকে নতুন কনটেইনার জাহাজ পোর্টে বার্থিংয়ের সুযোগ দেয়া, অস্থায়ী ভিত্তিতে এক্সপোর্ট ইয়ার্ডের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। আবার বন্দর কর্তৃপক্ষও কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। সেগুলো হলো শিপিং এজেন্ট মেইন লাইন অপারেটরদের (এমএলও) মধ্যে কমন ক্যারিয়ার এগ্রিমেন্ট করা, ডাইরেক্ট কলিং অব শিপ টু ফাইনাল ডেস্টিনেশন, এমএলওদের মধ্যে কনটেইনার সরাসরি আন্তঃবিনিময়, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডদের মাধ্যমে অফডকগুলোকে বিলম্বে কার্গো লোডিং প্ল্যান প্রদান না করা এবং অফডকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সর্বোপরি, বিশেষ ফিডার ভেসেল মাধ্যমে রফতানি পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা। এগুলো আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি। 

সমুদ্র বাণিজ্যে বরাবরই এক বন্দরের সঙ্গে আরেক বন্দর অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। বর্তমানে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রে যে হারে পণ্য রফতানি হচ্ছে, সে তুলনায় আমদানি হচ্ছে কম। বিশেষ করে মহামারী থেকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে চীনের রফতানি বাণিজ্যে গতি এসেছে। তারা বিপুল পণ্য রফতানি করেছে। প্রেক্ষাপটে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোয় সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। দেখা দিয়েছে কনটেইনার জাহাজের সংকট। এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। কাজেই এর সমাধানে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তঃবন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বিত প্রয়াসও দরকার। এক্ষেত্রে শিগগিরই আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয় ভূমিকা নেয়া চাই।

দেশে দেশে টিকাকরণ চলছে। জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ফলে আমাদের রফতানি গন্তব্য, বিশেষত ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। বিদ্যমান ক্রয়াদেশের পাশাপাশি নতুন ক্রয়াদেশ আসছে। ক্রয়াদেশগুলো যথাসময়ে মেটানো না গেলে ক্রেতারা আমাদের দেশ থেকে বিমুখ হবেন। প্রতিযোগী দেশগুলোয় চলে যাবেন, যেখানে যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করা হয়। এতে রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পোশাক রফতানি আমাদের অর্থনীতির বড় নিয়ামক। সুতরাং আজকে পোশাক মালিকরা পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে যে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন, তার দ্রুত অবসান প্রয়োজন। প্রস্তাবিত দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে তাই জরুরি ভিত্তিতে এক্ষেত্রে কার্যকর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে, যাতে রফতানি পণ্য পরিবহনে সম্ভাব্য যে কোনো বহিস্থ অভিঘাত মোকাবেলা করা যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন