অপ্রদর্শিত অর্থ সবচেয়ে বেশি বৈধ হয়েছে আ হ ম মুস্তফা কামালের সময়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক

অপ্রদর্শিত অর্থকে রাজস্বের আওতায় নিয়ে আসতে বিভিন্ন সময়ে তা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। কোন কোন পন্থায় এ অর্থ বৈধ করা যাবে, সে সম্পর্কে বাজেট প্রস্তাবের সময়ে ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রীরা। তাদের দেয়া সুযোগ নিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থকে মূলধারার অর্থনীতিতে নিয়ে এসেছেন অনেকেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ হয়েছে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সময়ে।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিলেও তাতে সাড়া মিলেছে এখনকার চেয়ে তুলনামূলক কম। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ প্রথম দেয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। তবে সে সময় তাতে সাড়া দেননি অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা। 

প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। ২০০০-০১ অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ রেখেছিলেন তিনি। ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে সময় ১ হাজার কোটি টাকার অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে যুক্ত হয়।

২০০৫-০৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ রেখেছিলেন আরেক প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। সে সময় অপ্রদর্শিত ৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা বৈধ হয়েছিল। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ হয়েছিল। সে সময় অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলে ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৯-১০ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ হয়েছে ১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা।

তবে সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত বৈধ হওয়ার পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী এ সময়ে ব্যক্তিশ্রেণীর প্রায় ১২ হাজার করদাতা মূলধারার অর্থনীতিতে ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত অর্থ যুক্ত করেছেন। এসব বিপুল পরিমাণ অর্থ বৈধকরণের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে রাজস্ব জমা হয়েছে ২ হাজার ৬৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

গত অর্থবছরে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ মূলধারায় যুক্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত অর্থবছরগুলোর বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলেও সেটি হাতেগোনা কয়েকটি খাতে বিনিয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত অর্থবছরের বাজেটে এ সুযোগ আরো বাড়ানো হয়।

মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র, বন্ড ও পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয় এ বাজেটে। বলা হয়, এক্ষেত্রেও আয়কর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। পুরো অর্থবছরেই ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের জন্য এ সুযোগ রাখা হয়।

এছাড়া দেশে বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে এর আগের অর্থবছরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে একই হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছিল সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ সুযোগ বলবৎ থাকবে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে ৭ হাজার ৫৫ জন করদাতা ১৬ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত বা নগদ টাকা বৈধ করেছেন। সে হিসেবে মোট বৈধ হওয়া অপ্রদর্শিত অর্থের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই ছিল নগদ খাতের। এ বাবদ পরিশোধিত কর থেকে সরকারের রাজস্ব এসেছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

তবে অপ্রদর্শিত অর্থ থেকে দেশের পুঁজিবাজারে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আসেনি। অর্থবছর শেষে দেখা যাচ্ছে মাত্র ২৮৬ জন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন ৪০২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ বাবদ সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৪০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে ৪ হাজার ৫১৮ ব্যক্তি জমি-ফ্ল্যাট কিনে ৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা বৈধ করেছেন। এখান থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৩৪১ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকে আমানত কিংবা সঞ্চয় স্কিমে নগদ অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিষয়টি তুলনামূলক সহজ হওয়ার কারণেই কিন্তু করদাতারা এর সুযোগ নিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। তবে গত বছর যা হওয়ার হয়েছে, আমি কোনোভাবেই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়ার পক্ষে নই। কারণ এ সুযোগ রাখলে যারা নিয়মিত কর দেন তারা নিরুৎসাহিত হন। কারণ সাধারণ করদাতাদের জন্য করহার ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে যারা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাদের জন্য ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এটি এক ধরনের বৈষম্য।

তিনি আরো বলেন, চলতি অর্থবছরে অবশ্য অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার ক্ষেত্রে জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। জরিমানা বাড়ানোর বিষয়টা ভালো সিদ্ধান্ত। তবে আমি মনে করি একটা নির্দিষ্ট সময় পর এ সুযোগ বন্ধ করে দেয়া উচিত।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার তালিকায় রয়েছেন ডাক্তার, সরকারি চাকরিজীবী, তৈরি পোশাক রফতানিকারক, ব্যাংকের স্পন্সর পরিচালক, স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আরো অনেকে। জুন শেষে প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ১১ হাজার ৮৬৯ জন করদাতা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি ব্যাংকে রাখা বিভিন্ন আমানত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা নগদ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু গত মাসেই ১ হাজার ৪৫৫ জন ৬১৯ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন।

চলতি অর্থবছরেও (২০২১-২২) বিনা প্রশ্নে নগদ টাকা, নতুন শিল্পে বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার, ফ্ল্যাট ও প্লট, ব্যাংক আমানতসহ বেশ কয়েকটি খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ রেখে অর্থবিল ২০২১ পাস হয়েছে। তবে এবার জরিমানা বাড়ানোর পাশাপাশি শর্ত আরেকটু কঠোর করা হয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করতে চাইলে এবার করদাতাদের তালিকাভুক্ত শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটসহ পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ইনস্ট্রুমেন্টে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ কর ও মোট করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে এ হার ছিল ১০ শতাংশ। এ সুযোগ নিয়ে কেউ যদি বিনিয়োগের পর তা এক বছরের মধ্যে তুলে নিতে চান সেক্ষেত্রে তাকে আরো ১০ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হবে। অন্যদিকে ২৫ শতাংশ কর ও করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে নগদ টাকা, ব্যাংক ডিপোজিট, ফাইন্যান্সিয়াল স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট ও সেভিংস ডিপোজিট, সেভিং ইনস্ট্রুমেন্ট অথবা সেভিং সার্টিফিকেট (সঞ্চয়পত্র) বৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা যাবে বলে অনুমোদিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে। এছাড়া জায়গা অনুপাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর ও জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত জমি, ভবন, অ্যাপার্টমেন্টে বিনিয়োগের মাধ্যমেও প্রশ্নাতীতভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে অর্থবিলে। পাশাপাশি অপ্রদর্শিত অর্থ ১০ শতাংশ কর দিয়ে নতুন শিল্পায়নেও বিনিয়োগ করা যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন