চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা কমই বাংলাদেশের

নিজস্ব প্রতিবেদক

চীনা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে এশিয়া ইউরোপের অনেক দেশ। কূটনীতির পরিভাষায় চীনের নীতিকে বলা হচ্ছে ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি শ্রীলংকা পাকিস্তানে চীনের ঋণ ফাঁদ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। চীনা অর্থায়ন রয়েছে বাংলাদেশ, নেপাল মালদ্বীপেও। অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন নিয়েছে বাংলাদেশ। যদিও দক্ষতার সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের ব্যবস্থাপনা করায় বাংলাদেশে চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা খুবই কম বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

চীন নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রায় ৭৫টি দেশে বিনিয়োগ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব সুফল আদায় করতে চাইবে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা বাংলাদেশ যাতে ঋণের ফাঁদে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখেই সব সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়। এসব প্রকল্পে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। তিস্তা নদী খনন, নদীর দুই পাড়ে তীর রক্ষাকাজ, চর খনন, স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ এবং বাড়িঘর রক্ষায় সামনের দিনগুলোয় আরো বেশি অর্থায়নের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। তবে এরই মধ্যে বেশকিছু প্রকল্প থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে। এছাড়া চীনা বিনিয়োগে নির্মিতব্য রেলেরও একাধিক প্রকল্প রয়েছে তালিকায়।

নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে চীন বাংলাদেশের পায়রা বন্দর প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষণে উঠে আসে। শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরের মতো বাংলাদেশের পায়রা বন্দর প্রকল্পটির নিয়ন্ত্রণও চীনের হাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান পায়রা বন্দর প্রকল্পের বিভিন্ন কম্পোনেন্টের জন্য এমওইউ সই করেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দরের ওপর সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

যদিও পায়রা বন্দর প্রকল্পটি নিয়ে এমন আশঙ্কার কোনো সত্যতা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পায়রা বন্দরের অন্যান্য কম্পোনেন্টের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করেছিল বাংলাদেশ, যার একটি ছিল ইউরোপের তিনটি দক্ষিণ কোরিয়ার। বিশ্লেষকরা বলছেন, পায়রা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটিকে ১৯টি কম্পোনেন্টে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি কম্পোনেন্টের জন্য আলাদা অর্থায়ন কৌশল বেছে নেয়া হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) সহযোগিতার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেলও বিদ্যমান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ড্রেজিং কাজে অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ। ভারত একটি টার্মিনাল নির্মাণে অর্থায়ন করছে। অন্যান্য কম্পোনেন্টে অর্থায়নের জন্য চীন জাপানের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। অবকাঠামো উন্নয়নের প্রায় সব প্রকল্পের ক্ষেত্রেই মডেল ব্যবহার করে আসছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে নেয়া। অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে নেয়া ঋণের চাপে পড়ার আশঙ্কা খুবই কম।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেন প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে এমন প্রচারণার পুরোটাই বানোয়াট। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪০ শতাংশের ওপর হলে সেটি চিন্তার কারণ। সেখানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ মাত্র ১৪ শতাংশ, যার মধ্যে চীনের অংশ আনুমানিক শতাংশ, যা আসলে খুবই কম। এটি একটি দেশের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে না। অনেকে শ্রীলংকার উদাহরণ দেন। তাদের ঋণের পরিমাণ তো ৪০০ শতাংশ। তারা ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। বাংলাদেশ তো এমন অবস্থায় নেই। ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাংলাদেশ কোনোদিন ডিফল্ট হয়নি। বাংলাদেশ সুপরিকল্পিতভাবে দক্ষতার সঙ্গে ঋণ ব্যবস্থাপনা করছে।

বাংলাদেশে চলমান বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পে চীনা প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন রয়েছে। হাজার ৪০০ মিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ তৈরি হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেল সংযোগের কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনা রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআইসি) প্রকল্পে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক।

এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিতব্য হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীন বিনিয়োগ করেছে ১৬ হাজার কোটির টাকার বেশি। রাজধানী ঢাকার বিদ্যুতের আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করছে চীন। বিশেষত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আওতায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে চীন।

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে বলেছেন, চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা বিনিয়োগ উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার পরও আমরা খুব সচেতন রয়েছি।

যদিও শ্রীলংকা, বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোনো দেশেই চীন ঋণের ফাঁদ তৈরির চেষ্টা করেনি বলে সম্প্রতি দাবি করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সহযোগিতায় ঋণ কখনো কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হয়ে উঠবে না। বাংলাদেশ খুব দক্ষতার সঙ্গেই বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা করে আসছে। বাংলাদেশের সুপরিকল্পিত নীতিগত কাঠামো এবং দক্ষ কর্মকর্তা মন্ত্রী রয়েছেন। তাই ব্যাপারে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

ভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রলইনের সাংবাদিক এডাম পিটম্যানের বিশ্লেষণেও চীনা ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের শঙ্কা উদ্বেগের তেমন কোনো কারণ নেই বলে উঠে এসেছে। তার মতে, চীনের ওপর ঢাকার নির্ভরশীলতা নেই এটা নিশ্চিত। বরং অবকাঠামো উন্নয়নই তাদের মূল লক্ষ্য।

ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে শ্রীলংকা তাদের দক্ষিণ উপকূলের হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের লিজে চীনের কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছে। হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে শ্রীলংকা যে ঋণ নিয়েছিল তার জন্য প্রতি বছর যে টাকা শোধ করতে হচ্ছে সেটা দেশটির মোট বার্ষিক ঋণ পরিশোধের শতাংশও নয়। শ্রীলংকা সরকারের মোট রাজস্বের ৯৫ শতাংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে।

চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) পরিকল্পনার আওতায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে পাকিস্তান। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নেয়া ঋণ এখন পাকিস্তানের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চীনের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নেয়া ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে না পেরে এক বছর সময় চেয়ে আবেদন করেছে পাকিস্তান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত মাসে বিষয়টি নিয়ে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

ইউরোপের দেশ মন্টেনিগ্রোও পড়েছে একই ধরনের সংকটে। দেশটির রাজধানী পডগোরিচার উপকণ্ঠে চীনের অর্থায়নে একটি হাইওয়ে প্রকল্প নির্মাণে চীনের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা। দেশটিতে এখন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে মহাসড়কের ব্যয় ঋণ নির্বাহ করতে গিয়ে পুরো দেশের অর্থনীতিই পঙ্গু হয়ে পড়তে পারে।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ঋণ বা অনুদান হিসেবে বাংলাদেশে অর্থায়ন শুরু করে চীন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে শুরুর পর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৩২০ কোটি ৯৮ লাখ ৪৬ হাজার ডলারের ঋণ, অনুদান বা অর্থসহায়তা দিয়েছে চীন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন