করোনাভাইরাস
মহামারী পৃথিবীর
যে কয়টি
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে
অবিশ্বাস্য গতি
দিয়ে বর্তমানে
নিয়ে এসেছে,
তার মধ্যে
অন্যতম হলো
ডিজিটালাইজেশন। বলা
যায় পুরো
পৃথিবীতে এখন
একটি ডিজিটাল
ট্রান্সফরমেশন চলছে।
মহামারী-পূর্ববর্তী
সময়ের বেশির
ভাগ অফলাইন
কাজকর্ম এখন
মানুষজন অনলাইনে
সারছে। এতে
ডিজিটালাইজেশনের যে
সুযোগ-সুবিধা,
তা সবাই
বুঝতে পারলেও
এর সুফল
সবাই সমানভাবে
পাচ্ছে না।
ফলে পৃথিবী
নতুন করে
এক বৈষম্য
মোকাবেলায় দাঁড়িয়েছে।
আজ থেকে
এক বছর
আগেও মানুষজন
কল্পনা করতে
পারত না
যে সে
দিব্যি প্রতিদিন
ঘরে বসে
অনলাইনে স্কুল,
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্লাস করতে
পারবে, পরীক্ষা
দিতে পারবে।
শুধু কি
তাই? আধুনিক
পৃথিবীর বেশির
ভাগ চাকরি,
ব্যবসা, কেনাবেচা,
লেনদেন ইত্যাদি
কাজ যে
নির্বিঘ্নে ঘরে
বসেই সেরে
ফেলা যায়,
এ ধারণার
জন্ম হয়েছে
এই করোনাকালেই!
ওয়ার্ক ফ্রম
হোম তাই
কেবলই একটা
সাময়িক ব্যবস্থা
নয়। গুগল,
ফেসবুক ইত্যাদি
টেক জায়ান্ট
এখন থেকেই
চাকরিপ্রার্থীকে রীতিমতো
অপশন দিচ্ছে
যে তারা
অফিসে নাকি
বাসায় বসে
কাজ করতে
চান? এমনকি
কিছুু এমপ্লয়িকে
তারা সারা
জীবনের জন্য
ওয়ার্ক ফ্রম
হোম করার
সুযোগ দিয়ে
দিচ্ছে।
অথচ দেখুন
এই যে
জুম, গুগল
মিট, গুগল
ক্লাসরুম ইত্যাদি
অ্যাপ্লিকেশন, যার
দ্বারা এই
মহামারীকালে ডিসট্যান্স
লার্নিং কিংবা
ওয়ার্ক ফ্রম
হোমের কাজ
করা সম্ভব
হয়েছে, সেগুলো
কিন্তু অনেক
আগে থেকে
ডেভেলপ করা।
গুটি কয়েক
মানুষ ছাড়া
এই চমত্কার
সব ডিজিটাল
অ্যাপ্লিকেশনস, ডিজিটাল
ক্লাসরুমের সুবিধার
কথা আমরা
আমজনতা জানতাম
না। এমআইটি,
হার্ভার্ডসহ আইভি
লিগের অন্যান্য
বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ডসহ
বিশ্বের নামিদামি
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়
কয়েক বছর
ধরে অনলাইনে
ডিসট্যান্স লার্নিং
প্রোগ্রামের মাধ্যমে
শিক্ষা ব্যবস্থাকে
ধীরে ধীরে
একটা ডিজিটাল
ট্রান্সফরমেশনের দিকে
নিয়ে যাচ্ছিল।
মহামারীর এই
অভূতপূর্ব অবস্থার
অবতারণা না
হলেও সম্ভবত
বলা যায়,
আগামী ২০৩০-৫০
সালের মধ্যে
অন্তত শিক্ষার
ক্ষেত্রে এই
ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া
প্রতিষ্ঠিত হয়ে
যেত।
মহামারীকালে মাত্র
এক বছরে
এখন ঘরে
ঘরে সবাই
জুম, গুগল
ক্লাসরুম কিংবা
গুগল মিটে
মিটিং করছে,
ক্লাস করছে।
সভা, সেমিনার,
থিসিস ডিফেন্স
থেকে শুরু
করে সায়েন্টিফিক
কনফারেন্স—কিছুই
কিন্তু থেমে
নেই! কী
চমত্কারভাবেই না
পৃথিবীবাসী এই
নতুন ডিজিটাল
বিশ্বে নিজেদের
খাপ খাইয়ে
নিয়েছে। বলা
বাহুল্য, মহামারী-পরবর্তী
পৃথিবী তার
এই ডিজিটাল
গতিপথ থেকে
খুব একটা
বিচ্যুত হবে
না। দুই
বছর আগে
আমাদের চেনাজানা
পৃথিবীর অনেক
নিয়ম, প্রথা
এখন পুরনো
এবং সেগুলো
ধীরে ধীরে
বিলুপ্ত হয়ে
যাবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার
পরে যে
সেক্টরটি মহামারীর
কারণে সবচেয়ে
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে, সেটি
হলো শিক্ষা
ব্যবস্থা। দেশী-বিদেশী
শিক্ষাবিদ এবং
শিক্ষা ও
গবেষণার সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট সবাই
একটি বিষয়ে
একমত। আর
তা হলো,
করোনা-পরবর্তী
পৃথিবীতে শিক্ষা
ব্যবস্থা আর
আগের মতো
থাকবে না।
এক্ষেত্রে অনেক
স্বল্পমেয়াদি ও
দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার
সম্মুখীন হতে
যাচ্ছি আমরা।
প্রথমত, মহামারীর
সময়ে শ্রেণীকক্ষের
পাঠদানের দীর্ঘ
বিরতি, ছাত্রত্ব
অব্যাহত রাখার
অনিশ্চয়তা, সংসারের
অভাব ইত্যাদি
নিয়ামক ও
প্রভাবক প্রাথমিক
স্কুলের শিশু
থেকে শুরু
করে বিশ্ববিদ্যালয়
পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের
মনস্তাত্ত্বিক জগতে
অনেক পরিবর্তন
এনেছে। এই
ছাত্রদের পুনরায়
ক্লাসরুমে ফিরিয়ে
নেয়ার পর
তার ফলাফল
কী রকম
হবে—এ
নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট
সবাই এক
রকম সন্দেহে
ভুগছেন।
দ্বিতীয়ত, ‘সবার
জন্যে শিক্ষা’—এ
প্রতিপাদ্য সামনে
রেখে গোটা
পৃথিবীতে একবিংশ
শতাব্দীর শুরুতে
শিক্ষার হার
বাড়ানোর ক্ষেত্রে
যে বিপ্লব
ঘটেছিল, সেটা
এই করোনার
সময় মুখ
থুবড়ে পড়েছে।
অনলাইনে ইন্টারনেটের
সাহায্যে শিক্ষাদান
কর্মসূচি চালাতে
গিয়ে বিপাকে
পড়েছে আমেরিকার
মতো উন্নত
দেশগুলোও। ইউনিসেফের
থেকে পাওয়া
তথ্যমতে, বিশ্বের
২ দশমিক
২ বিলিয়ন
শিশু ও
যুবা—যাদের
বয়স ২৫
বছর বয়সের
কম—তাদের
ঘরে ইন্টারনেটের
সংযোগ নেই।
অর্থাৎ বিশ্বের
প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ
শিশু অনলাইন
শিক্ষা ব্যবস্থার
সুবিধা থেকে
বঞ্চিত হচ্ছে।
খোদ আমেরিকায়
শহরতলির একটু
বাইরে গেলেই
নিম্ন আয়ের
পরিবারগুলো ইন্টারনেট
পরিষেবা গ্রহণ
করতে পারছে
না। পাশের
দেশ ভারতে
গত এক
বছরে দেখা
গেছে বিদ্যালয়গামী
শিশুদের একটা
বড় অংশ
স্মার্টফোন, ইন্টারনেট
ব্যবহারের সামর্থ্য
রাখে না।
দুঃখজনকভাবে এখন
পর্যন্ত বাংলাদেশে
ঠিক কতজন
শিক্ষার্থী ডিজিটাল
শিক্ষাদান কর্মসূচির
আওতার বাইরে
আছে, এর
কোনো সঠিক
পরিসংখ্যান আমাদের
জানা নেই।
তবে বিভিন্ন
তথ্য-উপাত্ত
থেকে পাওয়া
যায়, বাংলাদেশের
অধিকাংশ শিক্ষার্থী,
যারা বিশেষ
করে গ্রামে
বসবাস করছে
কিংবা মহামারীর
জন্য যাদের
পরিবার গ্রামে
ফিরে যেতে
বাধ্য হয়েছে
এবং প্রান্তিক
জনগোষ্ঠী, আর্থসামাজিকভাবে
যারা সমাজের
নিম্ন আয়ের
মানুষজন তারা
অনলাইনভিত্তিক এ
ডিসস্ট্যান্স লার্নিংয়ের
সুবিধা থেকে
পুরোপুরি বঞ্চিত।
এদের সংখ্যা
আশঙ্কাজনকভাবেই বড়।
ইউনিসেফ-ইন্টারন্যাশনাল
টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের
রিপোর্ট (ডিসেম্বর,
২০২০) অনুযায়ী,
বাংলাদেশের প্রায়
৬৩ শতাংশ
বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীর
বাড়িতে ইন্টারনেট
সংযোগ নেই।
নুন আনতে
পান্তা ফুরায়
জনগণকে মিড-ডে
মিল, উপবৃত্তি
ইত্যাদি প্রণোদনার
মাধ্যমে নিম্ন
আয়ের অনেক
দেশের মতো
বাংলাদেশও করোনা-পূর্ববর্তী
সময়ে এগিয়ে
যাচ্ছিল শতভাগ
শিক্ষিত দেশের
কাতারে নাম
লেখাতে। কিন্তু
বৈশ্বিক ২০৩০
এজেন্ডার অন্যতম
লক্ষ্য সবার
জন্য মানসম্মত
শিক্ষা (এসডিজি-৪)
অর্জন মহামারীকালে
আজ অনেকটাই
হুমকির সম্মুখীন।
করোনাভাইরাস মহামারী
ডিজিটালাইজেশনকে যে
বিশাল ধাক্কা
দিয়ে পৃথিবীকে
রাতারাতি যে
কয়েক বছর
এগিয়ে নিয়ে
গেছে, তাতে
আবার ঠিক
ততটাই পিছিয়ে
পড়েছে সমাজের
পেছনে পড়ে
থাকা দরিদ্র
মানুষজন। আর
তাই অর্থনীতিবিদদের
কাছে নতুন
করে যে
ইনইকুয়ালিটির বিষয়টি
উঠে এসেছে
তা হলো
ডিজিটাল ইনইকুয়ালিটি।
ডিজিটাল ইনইকুয়ালিটি
নতুন করে
উন্নত-অনুন্নত
দেশগুলোর আয়বৈষম্য,
শহর-গ্রামের
ব্যবধানকে বিশ্বব্যাপী
প্রকট করে
তুলেছে। উন্নত
বিশ্বের উচ্চ
আয়ের দেশগুলোয়
যেখানে ৮৭
শতাংশ বিদ্যালয়গামী
শিশুদের বাড়িতে
ইন্টারনেট সুবিধা
রয়েছে, সেখানে
অনুন্নত-গরিব
দেশে সেই
সংখ্যা মাত্র
৬ শতাংশ।
সারা বিশ্বে
গ্রামে বসবাসকারী
শিশুদের মধ্যে
মাত্র ২৫
শতাংশের অনুকূলে
ইন্টারনেট সুবিধা
আছে, যেখানে
শহরে এ
সুবিধাপ্রাপ্ত প্রায়
৪১ শতাংশ।
অঞ্চলভেদে কোথাও
কোথাও এ
ব্যবধান আরো
অনেক বেশি।
এ ব্যবধান
সবচেয়ে বেশি
দেখা যায়
পরিবারের আয়বৈষম্যের
ফলে।
এতে আসলে
সমস্যাটা কোথায়
হচ্ছে? মূল
যে সমস্যাটা
ভবিষ্যতে দেখা
দেবে তা
হলো, শিক্ষার
অভাবে একটা
পুরো প্রজন্ম
পিছিয়ে যাওয়ার
আশঙ্কা রয়েছে।
আমরা এর
ফলে একের
অধিক প্রজন্মের
মধ্যে দারিদ্র্যের
একটি চক্রে
(intergenerational
poverty) আপতিত
হতে যাচ্ছি।
আইএলওর সাম্প্রতিক
প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, বর্তমানে
সারা বিশ্বে
তরুণদের বেকারত্বের
হার ১৪
দশমিক ৬
শতাংশ। তবে
শক্তিশালী অর্থনীতির
দেশগুলো, যারা
মহামারীকালে তুলনামূলকভাবে
বেশি প্রণোদনা
দিতে পেরেছে,
তাদের মধ্যে
বেকারত্বের হার
কম। আবার
মধ্য ও
নিম্ন আয়ের
দেশে করোনাকালে
বেকারত্বের হার
বেশি। আবার
দেখা গেছে
২৫ বছরের
কম বয়সীদের
মধ্যে এই
বেকারত্বের হার
সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে মহামারীকালে
সৃষ্ট সংকটে
বিদ্যালয়ের ঝরে
পড়া শিশুর
সংখ্যা যেমন
বেড়েছে, তেমনি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ
থাকায় স্নাতক-স্নাতকোত্তর
পর্যায়ের অসংখ্য
শিক্ষার্থী যারা
এই দুই
বছরে চাকরির
বাজারে প্রবেশ
করতে পারত,
তারা এক
অনিশ্চয়তার জালে
আটকে গেছে।
বেকারত্বের হার
বৃদ্ধি পাওয়ায়
নতুন করে
চাকরিপ্রার্থীরা যখন
চাকরির বাজারে
প্রবেশ করবেন
তখন তাদের
এরই মধ্যে
চাকরির বাজারে
অভিজ্ঞদের সঙ্গে
চাকরি পাওয়ার
দৌড়ে অবতীর্ণ
হতে হবে।
সব মিলিয়ে
এখন থেকেই
আমাদের আশু
সংকট থেকে
উত্তরণের জন্য
বিভিন্ন স্বল্প
ও দীর্ঘমেয়াদি
পরিকল্পনা হাতে
নিতে হবে।
প্রথমত, শিক্ষার্থীদের
জন্য ডিজিটাল
বৈষম্য দূর
করতে আশু
ব্যবস্থা গ্রহণ
করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য
আলাদা ইন্টারনেট
প্যাকেজ, মোবাইলের
ব্যবস্থা করা
অথবা শিক্ষার্থীদের
জন্য আলাদা
প্রণোদনার ব্যবস্থা
করা যেতে
পারে। দ্বিতীয়ত,
বিশ্ব যে
ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের
দিকে দ্রুতগতিতে
এগিয়ে চলেছে,
তার সঙ্গে
তাল মিলিয়ে
যোগ্য, দক্ষ
ডিজিটাল প্রজন্ম
গড়ে তুলতে
পরিকল্পনা ও
উদ্যোগ হাতে
নিতে হবে।
তৃতীয়ত, চাকরির
বাজার সম্প্রসারণের
সঙ্গে সঙ্গে
বিকল্প পেশা
(যেমন উদ্যোক্তা)
গড়ে তুলতে
হবে। এক্ষেত্রে
সরকারি পদক্ষেপ
ও বিভিন্ন
প্রণোদনা প্যাকেজ
ও সহজ
ঋণ সুবিধার
ব্যবস্থা করতে
হবে। সব
শেষে, বাজেটে
শিক্ষা খাতে
বরাদ্দ বৃদ্ধির
কথা মোটামুটি
সবাই বলে
আসছেন। গত্বাঁধা
শিক্ষা বাজেট
দিয়ে আসলে
বর্তমানের এবং
ভাবি ডিজিটাল
ইনইকুয়ালিটি মোকাবেলা
সম্ভব নয়।
উদ্ভূত বিশেষ
এ সংকট
মোকাবেলায় শিক্ষা
খাতের বাজেট
ও এডিপির
অর্থায়নে বিশেষ
পরিকল্পনা গ্রহণ
করে বাজেট
বরাদ্দ ব্যাপক
হারে পরিবর্তিত
ও পরিবর্ধিত
হওয়া এখন
সময়ের দাবি।
উন্নত দেশ
মানে হলো
উন্নত মানুষ।
শিক্ষা-দীক্ষা,
চিন্তা, মননে,
সৃষ্টিশীলতায় মানুষ
উন্নত হলেই
উন্নত হয়
তার দেশ।
আগামী ডিজিটাল
পৃথিবীর জন্য
দক্ষ জনবল
তৈরি করতে
করোনাকালে উদ্ভূত
এ ডিজিটাল
বাধা অতিক্রম
করার কোনো
বিকল্প নেই।
নয়তো আয়বৈষম্য
ও লিঙ্গবৈষম্যের
সঙ্গে নতুন
এ ডিজিটাল
বৈষম্যে নতুন
করে পিছিয়ে
যাবে আমাদের
এরই মধ্যে
পিছিয়ে থাকা
জনগোষ্ঠী।
সাঈদা জাহান:
শিক্ষক,
অর্থনীতি বিভাগ
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা