প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

১৯২১ থেকে ২০২১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম জন্মদিন জুলাই। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাসে অয়োময় প্রভাবক ভূমিকা পালনকারী বিদ্যাপীঠ গত এক শতাব্দীকালে দেশ জাতিগত ভাবাদর্শ নানান আন্দোলনের নেতৃত্ব নির্মাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের  জনগণ আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করে, মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল হয়। কালের কপোলতলে দেশ জাতির নব উত্থান অগ্রযাত্রার সোপান সূচনায় যারা নিজেদের বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্ব, অকুতোভয় সাহস, বিদ্যা-বিনয় আর মেধার সমন্বয়ে বিকশিত বিচক্ষণতা দূরদৃষ্টিক্ষেপে নিবেদিত নিষ্ঠাবান ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে যাদের নেপথ্য কর্মকুশলতা আর সাংগঠনিক অবয়ব লাভের সূচনালগ্নে যাদের সক্রিয়-সোচ্চার সাহসিকতাপূর্ণ গঠনমূলক অয়োময় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তাদের নাম পরিকীর্তিত হবে। স্মরণীয় বরণীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলাভের ইতিহাস দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সাবেক বর্তমান সব শিক্ষার্থীসহ সবার কাছে অনুপম অনুভবের বিষয়। 

১৯০৫ সালে বঙ্গভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের রাজধানী হিসেবে ঢাকার গুরুত্ব মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং একই সঙ্গে আসাম পূর্ববঙ্গের জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা অধিকতর স্বায়ত্তশাসন লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক সম্পদে স্বয়ম্ভর হয়েও পূর্ব বাংলা ছিল শিক্ষাদীক্ষায়, চাকরি, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যে নানাভাবে অবহেলিত, বঞ্চিত। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ সূচিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনে মেতে ওঠে বাংলা বিভাগ বিরোধীরা। সেই তীব্র আন্দোলন প্রতিরোধের মুখে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারত সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে। ঘোষণায় পূর্ববঙ্গের জনগণ, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় নিদারুণ আশাহত হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) বঙ্গভঙ্গ রদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ১৭ ২০ ডিসেম্বর দুটি হাতের লেখা চিঠি পাঠান ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে। ১৭ তারিখের চিঠিতে খাজা সলিমুল্লাহ  বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের মর্মাহত হওয়ার বেদনা এবং ক্ষোভের কথা তুলে ধরেন এবং ২০ তারিখের চিঠিতে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সার্বিক উন্নতি বিধানে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু সংস্কারসহ মুসলিম শিক্ষার তত্ত্বাবধানের জন্য শিক্ষা বিভাগে একজন যুগ্ম পরিচালক কিংবা সহকারী জনশিক্ষা পরিচালকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব রাখেন। পত্রের উপান্তে নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে গভর্নর বাহাদুরের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। পত্র পাওয়ার পরদিনই [২১ ডিসেম্বর] ভাইসরয় তার উপদেষ্টা পর্ষদের শিক্ষা সদস্য স্যার এইচ. বাটলার সাহেবকে নবাবের পত্রের প্রস্তাববলি, বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা তত্ত্বাবধানের জন্য বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চেয়ে নোট দেন। নোটে ভাইসরয় তার পর্ষদের কাছে প্রশ্ন রাখেন ঢাকায় মুসলিম ছাত্রদের হোস্টেলসহ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ভারতে ব্রিটিশ সরকারের তরফে একটি বিচক্ষণ পদক্ষেপ হবে কিনা। ভাইসরয়ের উপলব্ধি ছিল তার উদ্যোগকে পূর্ববঙ্গবাসীরা স্বাগত জানাবে এবং এটি পূর্ববঙ্গ প্রদেশে মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হবে।

ভাইসরয় হার্ডিঞ্জের ঢাকা সফরের সময় ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি তার সঙ্গে খাজা সলিমুল্লাহসহ পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতাদের ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করেন। তাদের পেশ করা বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাইসরয় তাদেরকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটি প্রথম অবগত করেন। প্রতিনিধি দলের সাক্ষাতের একদিন পরই ফেব্রুয়ারি ১৯১২ সরকার অফিশিয়াল কমিউনিকের মাধ্যমে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতায় নামে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, হিন্দু জমিদার এবং স্টেটসম্যান বেঙ্গলী পত্রিকা। ১২ ফেব্রুয়ারি প্রখ্যাত আইনজীবী . রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আপত্তি উত্থাপন করেন। সরকার আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকে, ১৯১২ সালের ২৭ মে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে রেজল্যুশন জারি করে এবং ব্যারিস্টার নাথানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন স্কিম প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করে। কমিটি ১৯১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর রিপোর্ট দাখিল করে এবং ২৬ ডিসেম্বর সেই রিপোর্টের ওপর সব মহলের মতামত আহ্বান করা হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের প্রভাবশালী সদস্যরা ১৯১৩ সালের মার্চ সিনেটের নবম অধিবেশনে প্রত্যেকে লিখিতভাবে নাথান কমিটির রিপোর্টের বিরূপ সমালোচনা করে। সেক্রেটারি অব স্টেট ১৯১৩ সালের ডিসেম্বরে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন করেন। কিন্তু এরই মধ্যে প্রথম মহাসমর শুরু হয়ে যাওয়ায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম থমকে যায়।

প্রথম মহাসমরের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ থমকে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯১৪ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা প্রেসিডেন্সি মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতির ভাষণে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিলম্ব এবং নাথান কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়নের পরিবর্তে কিছু ভিন্নমাত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উদ্বেগ উত্কণ্ঠা প্রশমনের উদ্দেশ্যে দিল্লির নির্দেশে বাংলার ডিপিআই ডব্লিউ ডব্লিউ হর্নেল সাহেবের নেতৃত্বে বাংলা সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করে। হর্নেল কমিটির পর্যবেক্ষণ পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এর আইন-কানুন প্রণয়নে যুক্তি বাদানুবাদের ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত হিসেবে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। হর্নেল সাহেবের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন সহকর্মী প্রেসিডেন্সি বিভাগের অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর আহ্ছানউল্লা কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত যে শিক্ষা দপ্তরে বিশেষ কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি পদায়নে নবাব সলিমুল্লার প্রস্তাব এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভাইসরয়ের ধারণার শুভ সূচনার সফল বাস্তবায়ন হিসেবে পরবর্তীকালে দেখা যায় বঙ্গদেশের মোছলেম শিক্ষার সহকারী ডিরেক্টর পদে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার প্রথম নিযুক্তি।

১৯১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না দেখে পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা উদ্বেগ উত্কণ্ঠা প্রকাশ করলে ১৯১৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠিত হয়। কমিশন বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্বিক সংস্কার উন্নয়নকল্পে যে বিশাল প্রতিবেদন প্রণয়ন করে, সেখানে বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সংস্কারকল্পে কমিশনের পর্যবেক্ষণ সুপারিশমালায় হর্নেল কমিটির ফাইন্ডিংস বারবার প্রাসঙ্গিকতায় আসে। কমিশন দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, ভাবুক, চিন্তাবিদ, শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, বিদ্যানুরাগীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট ২২টি প্রশ্নের ওপর লিখিত অভিমত সংগ্রহ করে। প্রশ্নমালার মধ্যে ঢাকাসহ মফঃস্বল বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন, এখতিয়ার ভূমিকা, শিক্ষা কার্যক্রম, কারিকুলাম, প্রশাসনিক বিন্যাস, উচ্চশিক্ষায় সম্প্রদায়গত স্বার্থ-সম্পর্কিত প্রসঙ্গগুলো হর্নেল কমিটির পর্যবেক্ষণের আলোকে উঠে আসে।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের চার নম্বর প্রশ্নের বিষয়বস্তুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে এবং সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ারে স্কুল কলেজগুলোর অধিভুক্তির প্রসঙ্গটি। উল্লেখ্য, বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আপত্তি নেতিবাচক মনোভাবের ভিত্তি। চার নম্বর প্রশ্নের জবাবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাসহ মুসলিম শিক্ষবিদ নেতাদের তাদের স্মারকলিপিতে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান প্রশাসনিক প্রগলভতা এবং উচ্চতর শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এর সীমাবদ্ধতার স্বরূপ তুলে ধরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যুক্তিকে তারা কলিকাতায় আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং সেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কন্ধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু দায়দায়িত্ব অর্পণের সঙ্গে সমান্তরালে এনে জোরালো করেন। ভারত সরকার ১৯১৬ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে ১৯১৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠিত হওয়ায় সে উদ্যোগে আবার ভাটা পড়ে।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ১৯১৯ সালে রিপোর্ট দাখিল করলে সেখানে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সপক্ষে কমিশনের ইতিবাচক অভিমতসহ সুপারিশ থাকায় সরকার আর বিলম্ব না করে আসন্ন সেপ্টেম্বরের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন, ১৯১৯ উত্থাপনের পরিকল্পনা জানিয়ে শিক্ষা সচিব কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ১১ আগস্ট পত্রযোগে জানান। সরকারের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৯ সালের ২৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত ১১তম সিনেট সভায় কমিশনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ না দিয়েই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আইন প্রণয়নে সরকারি উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং সিনেট সভার সম্পূর্ণ কার্যবিবরণী দিল্লিতে পাঠানো হয় টেলিগ্রাম যোগে। সরকার ব্যাপারে আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং ১১ সেপ্টেম্বর ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল উত্থাপিত হয়। সরকার ১৯১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরের পত্রে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবিলম্বে খসড়া আইনের ওপর চূড়ান্ত অভিমত প্রেরণের সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানায়। পরিপ্রেক্ষিতে নভেম্বরের তারিখের সিনেটের ১৪তম অধিবেশনে নয় সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় খসড়া আইন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে মতামত সুপারিশ পেশের জন্য। এই বিশেষ কমিটিতে একমাত্র বাঙালি মুসলমান সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে একমাত্র বাঙালি মুসলমান সদস্য খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (১৮৭৩-১৯৬৫), যিনি বিলের প্রতিটি অনুচ্ছেদ অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ স্বার্থ সংরক্ষরণে তিনি পদে পদে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেন। কমিটির রিপোর্টে বিধৃত সব মতের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই তিনি একমত হতে পারেননি। সে কারণে ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি চার পৃষ্ঠার একটি নোট অব ডিসেন্ট দাখিল করত রিপোর্টে স্বাক্ষর করেছিলেন। তার নোট অব ডিসেন্টটি কমিটির রিপোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯১৯ পরীক্ষা বিবেচনার জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের রিপোর্ট পেশ করলে ডিসেম্বরের ১৭ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত সময়ে সিনেটের বিশেষ অধিবেশনগুলোয় কমিটির রিপোর্টের ওপর বিস্তারিত আলোচনা এবং আইনের প্রতিটি অনুচ্ছেদ তফসিলের ওপর পর্যালোচনা ভোটাভুটির মাধ্যমে সিনেটের সংশোধন প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং সেটি সরকারের কাছে দাখিল করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মধ্যে পূর্ববঙ্গের বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের সার্বিক স্বার্থ তথা তাদের উচ্চশিক্ষা প্রসারকল্পে আনীত বিধিবিধান ব্যবস্থাবলি-বিষয়ক মৌলিক কয়েকটি ক্ষেত্রেই আবর্তিত হচ্ছিল বাদানুবাদ, আপত্তি উত্থাপন আর গ্রহণ-বর্জনের বিতর্কে। প্রধান যে বিষয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে, সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদ কমিটিতে বিশেষ সম্প্রদায়কে বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দানের প্রসঙ্গ নিয়ে। কমিটির রিপোর্টের প্রথম অনুচ্ছেদেই ব্যাপারে জোরালো আপত্তি প্রকাশ পায়। এর বিপরীতে  সিনেটর খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা যেকোনো জাতির বা সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নে রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষার সর্বজনীন সম্পৃক্ততার অনিবার্যতা তুলে ধরেন।

বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের জনগণের সার্বিক উন্নয়ন দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ে সৃজিত সমস্যা, বাধাদানে গৃহীত ব্যবস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি যাতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের জন্য কল্যাণবহ না হতে পারে, সে ব্যাপারে সব প্রকার ষড়যন্ত্রের মুখে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীসহ মুসলিম শিক্ষাবিদ শিক্ষা কর্মকর্তারা অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম শতবর্ষ উদযাপন প্রাক্কালে সেসব মহৎ প্রাণ ব্যক্তিত্বকে স্মরণ, তাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন জাতীয় দায়িত্ব কর্তব্য।

 

. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন