ফিরে দেখা

রমেশচন্দ্র মজুমদারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. এম এ মোমেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা কলকাতার বিশিষ্ট হিন্দুরা করেছে কিনা, করলে কতটা করেছে, তার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমন করে প্রতিষ্ঠিত হলো, রমেশচন্দ্রের নিজের ভূমিকাই বা কী ছিল খোলামেলা কথায়। তিনি সত্যটাই জানিয়ে দিয়ে গেছেন তার আত্মজীবনী জীবনের স্মৃতিদ্বীপে গ্রন্থে। বরাবর ধর্মীয় রাজনীতির আলোকেই বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। যদি এমন হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জায়গায় সে সময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলমান পণ্ডিত স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থাকতেন তিনি কি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ হাসিমুখে বিসর্জন দিতে রাজি হতেন?

এমনিতেই দ্বিতীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কলকাতার জন্য একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করা; আর বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যাবে। সে সময় ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হতো এবং পদ্ধতি ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। সব মিলিয়ে পূর্ব বাংলার স্কুল কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়েরও অন্যতম উৎস ছিল। আর্থিক স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিকভাবেই ক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। সম্ভব হলে তা প্রতিহত করার চেষ্টা চলবে, এটাও স্বাভাবিক। পূর্ব বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোর প্রতিবাদকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। বিরোধীদের অন্যতম দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন রাসবিহারী ঘোষ গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বলা হয়ে থাকে তাদের বিরোধিতার তীব্রতা কমাতে লর্ড হার্ডিঞ্জ হিন্দু প্রতিবাদী নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিক্ষেত্র ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ মাইল পরিধির মধ্যে সীমিত থাকবে আর এর বাইরের গোটা পূর্ব বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথারীতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে।

বাস্তবতা হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১২ সালে প্রতিশ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল যথেষ্ট পিছিয়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রমেশচন্দ্র মজুমদারকে যা বলেছেন তিনি তা আশুতোষেরই ভাষায় লিপিবদ্ধ পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।

সিনেট হাউজ থেকে বেরিয়ে রমেশচন্দ্র দেখলেন স্যার আশুতোষ গাড়িতে উঠছেন। তিনি রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ডাকলেন, বললেন, চলো আমার সঙ্গে।

গাড়িতে স্যার আশুতোষ যা বললেন রমেশচন্দ্রকৃত তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

একদিন হাইকোর্টে গেছি, এমন সময় বড়লাটের বাড়ি থেকে জরুরী মার্কা এক চিঠি পেলাম। খুলে দেখি বড়লাটের প্রাইভেট সেক্রেটারি লিখেছেন যে, হাইকোর্ট থেকে ফেরার সময় আমি যেন বড়লাটের সঙ্গে দেখা করে যাই। চিঠিতে যে সময় লেখা ছিল, ঠিক তখনই আমি গেলাম। যাওয়া মাত্রই প্রাইভেট সেক্রেটারি আমাকে একেবারে সোজা বড়লাটের কামরায় নিয়ে গিয়ে এবং সেখানে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলেন। বড়লাট ঘরে ঢুকে দু-এক কথার পরই আমাকে বললেন, দেখো এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তোমরা খুব উত্তেজনার সৃষ্টি করছ। বিশ্ববিদ্যালয় আমরা করবই। কিন্তু আমি গোলমাল ভালোবাসি না। এই বিরোধী দলের মধ্যে তুমি যে একজন প্রধান তা আমি জানি এবং তোমার প্রতিবাদকে আমি ভয় করি। তুমি তো জান আমি কূটনীতি বিভাগে ছিলাম। কাজ উদ্ধারের রীতি আমার ভালোই জানা আছে। তোমাকে আমি সোজাসুজি জিঞ্জেস করছিতোমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কি পেলে তুমি এই প্রতিবাদ বন্ধ করতে রাজী আছ? আমি এর জন্য যথোচিত মূল্য দেব। হঠাৎ এই প্রস্তাব শুনে আমি কিছুই স্থির করতে পারলাম না। কিন্তু বড়লাট চাইলেন আমি যেন তখনই একটা জবাব দিই; বাইরে গেলে অন্য লোকের সঙ্গে পরামর্শ করে হয়ত আমার মতিগতি বদলে যেতে পারে। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলামকী বলি। তখন তিনি আবার বললেন যে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হবেই। কিন্তু তুমি ইচ্ছে করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু করে নিতে পারো। তখন আমি বললাম, আচ্ছা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব না যদি ভারত সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করেন। বড় লাট তখনই এতে রাজী হলেন। বললেন, তাই হবে। তোমার সঙ্গে আমার এই যে কথাবার্তা হল এটি আমার দপ্তরে ঢাকা প্যাক্ট বলে লেখা থাকবে

সেই চার অধ্যাপকের পদ হচ্ছে: প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের জন্য কারমাইকেল প্রফেসর, অর্থনীতির জন্য মিন্টো প্রফেসর, দর্শনের জন্য পঞ্চম জর্জ প্রফেসর গণিতের জন্য হার্ডিঞ্জ প্রফেসর।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যে বড়লাটের কথা বলেছেন তিনি লর্ড চেমসফোর্ড, ১৯১৬ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত ভারতের ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল, লর্ড হার্ডিঞ্জের পর তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯১৭ থেকে ১৯২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ছোটোলাট অখণ্ড বাংলার গভর্নর ছিলেন আর্ল অব রোনাল্ডশে। তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চ্যান্সেলর। রমেশচন্দ্র মজুমদার রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতো শক্তিশালী প্রার্থীকে পেছনে ফেলে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ শেষ করে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে ঢাকা ট্রেনিং কলেজে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুবোধ মুখোপাধ্যায় সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়ায় স্যার আশুতোষ তাকেই বললেনরমেশকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দাও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাইলে যেন তার সাথে দেখা করেন।

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছা নিয়েই তিনি ৬০০ টাকা বেতনের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অধ্যাপক পদে ১৮০০ টাকা বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা লগ্নেই যোগ দিলেন। তখনকার দিনে আঠারশো টাকা বেতনের পদ কেউ আমাকে দেবেন এমন আশা আমার ছিল না। প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হার্টগ সাহেবই তাকে বেছে নিয়েছেন। কলকাতায় তার শেষ দিককার স্মৃতিগুলো সুখকর নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারীরা বিভিন্নভাবে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করে। তাদের একজন ভারতীয় ইতিহাস সংস্কৃতির অধ্যাপক দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকর এক আশ্রমের গল্প ফেঁদে হার্টগকে বলেন। অসুর আর অর্থলোভে রমেশচন্দ্র আশ্রম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলে তিনিও অভিশপ্ত এবং অচিরেই অসুরত্বপ্রাপ্ত হবেন। এমনকি তার পিএইচডি থিসিস করপোরেট লাইফ ইন ইন্ডিয়া প্রকাশনার সমুদয় ব্যয় হাজার টাকা পরিশোধ করে তাকে বইয়ের কপিগুলো নিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়—‘পুনার ওরিয়েন্টাল এজেন্সির কাছে সামান্য রয়্যালটি নিয়ে এই বইগুলি আমি বিক্রি করে দিই এবং সেই টাকাতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপার খরচ শোধ করি।

দেশে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর মতো যোগ্য লোকের অভাব ছিল? চার হাজার টাকা বেতন দিয়ে ফিলিপ হার্টগকে কেন আনা হলো তা কলকাতার অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হয়েছিল। রমেশচন্দ্রের মূল্যায়নটি বস্তুনিষ্ঠ: স্যার ফিলিপ হার্টগ অতি যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। প্রথমাবধিই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য যথেষ্ট চিন্তা পরিশ্রম করতেন। তিনি যেসব নিয়মকানুন প্রবর্তন করেছিলেন পরবর্তীকালে তারই ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক রকম উন্নতি সম্ভবপর হয়েছিল। সাধারণত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব দোষত্রুটি দেখা যায় তার অনেকগুলি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি তার জন্য হার্টগের যথেষ্ট কৃতিত্ব আছে।

১৯২১-এর জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। জুনের শেষদিকে রমেশচন্দ্র মজুমদারসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আরো যে জন শিক্ষক একসঙ্গে ঢাকায় যোগদানের জন্য যাত্রা করেন তাদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন বসু, নলিনী বসু, মুহম্মদ শহীদুল্লা, হরিদাস ভট্টাচার্য প্রমুখ। রমেশচন্দ্র জানান, অল্পদিন পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্ঞান ঘোষ বিলেত থেকে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

সূচনাকালের শিক্ষকদের মধ্যে লাল, নীল, সাদা, গোলাপি ডোরাকাটা ধরনের বিভাজন না থাকলেও একটি সংগত বিভাজনের চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই সরকারি ঢাকা কলেজ বর্তমান ছিল, যেখানে এমএ পর্যন্ত পড়ানো হতো আর বেসরকারি ছিল জগন্নাথ কলেজ, যেখানে বিএ পর্যন্ত পড়ানো হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি ঢাকা কলেজে স্নাতক স্নাতকোত্তর পাঠের এবং জগন্নাথ কলেজে স্নাতক পাঠের অবসান ঘটাল। ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে সংগত কারণেই অসন্তোষ দেখা দিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনের তাগিদেই ঢাকা কলেজের জন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য গ্রহণ করল। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন ভারতীয় শিক্ষা সার্ভিসের (কেন্দ্রীয়) এবং অন্যরা বাংলার প্রাদেশিক সার্ভিসের। তারা স্ববেতনে সরকারি বিধিবিধানের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন। জগন্নাথ কলেজের জন শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা বেতন-ভাতা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী গ্রহণ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর সরকারের নিয়োগকৃত শিক্ষকরা মর্যাদায় পিছিয়ে পড়েন। ফলে তারা সরাসরি নিয়োগকৃত শিক্ষকদের প্রতি বিরুদ্ধ ভাব পোষণ করতেন। এই দুই দলের পূর্ণ মিলন কখনো হয়নি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি নিয়োগের শিক্ষকের সংখ্যা কমতে থাকে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষক সংখ্যায় এত বেশি হয়ে পড়ে যে এই দুটি পৃথক শ্রেণীর শিক্ষকদের মধ্যে যে প্রভেদ ছিল সেটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হওয়ার পর গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের তিনজন সদস্যের জন্য ঢাকায় তিনটি বাড়ি নির্মিত হয়: বর্ধমান হাউজ, সামসুল হুদা হাউজ এবং হুইলার হাউজ। বাড়ি নিয়ে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করে রমেশচন্দ্র পেলেন বর্ধমান হাউজের (বাংলা একাডেমির পুরনো ভবন) দোতলা—‘সাতটি ঘরএকটি তো প্রকাণ্ড হল, বাকী ঘরগুলিও বেশ বড় বড়।... ধরনের বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। তিনি আরো লিখেছেন, কলকাতা থেকে ঢাকায় এরকম সুন্দর বাড়িতে থাকায় যে খুব আরাম আনন্দ লাভ করেছিলাম তা বলা বাহুল্য।

বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সরকারে ন্যস্ত হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী প্রভাষচন্দ্র মিত্র জানিয়ে দিলেন শিক্ষকদের বেতনের ভার বহন করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। বাস্তবিকই ১৮০০ টাকার প্রতিশ্রুত বেতন ১০০০ টাকায় নেমে এল। বিভাগীয় প্রধান হওয়ার কারণে আরো ২৫০ টাকা ভাতা এর সঙ্গে যুক্ত হয়। আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে যখন হারিয়ে দিলেন, এই কীর্তি কলকাতায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জন্য আনন্দ সংবাদ হয়ে দেখা দেয়। শাস্ত্রী মহাশয় ছিলেন আশুতোষের বিরোধী শিবিরের। সুতরাং তার পরাজয়ে আনন্দিত উপাচার্য বলেই ফেললেন: শাস্ত্রী আমার সঙ্গে লাগতে আসে; আমার এক ছোকরা শিষ্যের কাছেই সে নিজে হেরে গেল।

রমেশচন্দ্র লিখেছেন: কিন্তু কি কারণে জানি না আচার্য যদুনাথ সরকার, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্যার আশুতোষের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ ছিলেন। স্যার আশুতোষও তাঁদের মোটেই প্রীতির চক্ষে দেখতেন না। একবার কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাদের কাছে বলেছিলেন যে, তিনজন লাটসাহেব হন, তাতেও তাঁর আপত্তি নেই, যদি তাঁরা বাংলাদেশের বাইরে থাকেন। বহু চেষ্টা করেও এই মনোমালিন্যের কারণ কিছু আমি নির্ণয় করতে পারিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হিন্দুরা যে স্বাগত জানায়নি এবং অনেকক্ষেত্রে বিরোধিতাও করেছে এটা রমেশচন্দ্র নির্দ্বিধায় লিখেছেন (জীবনের স্মৃতিদ্বীপে তার ৯০ বছর বয়সে ডিকটেশন দিয়ে লেখা স্মৃতিকথা, কিন্তু তিনি ভূমিকাতে স্পষ্টভাবেই বলেছেন, এই গ্রন্থে প্রকাশিত মতামতের জন্য আমিই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। তবে এইটুকু বলতে পারি, আমি জ্ঞাতসারে সত্যের অপলাপ করি নাই।)—‘হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল বঙ্গবিভাগ রহিত করায় মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে অনেকটা তা পূরণ করার জন্যই এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদে হিন্দু শিক্ষকেরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন তথাপি কোর্টের হিন্দু সভ্যরা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রীতির চোখে দেখেননি। শুরুতেই অনেকের আশঙ্কা ছিল হিন্দু মুসলমান শিক্ষক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ দেখা দেবেকিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি। রমেশচন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকালে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি উদাহরণ তুলে ধরে খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাই খাজা শাহাবুদ্দিনের পুত্র ইতিহাসে অনার্স পরীক্ষা দিয়ে কয়েক নম্বরের জন্য অনার্স পাস করেনিকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অবস্থান নেওয়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল।

বাস্তবিকই পরীক্ষার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুবই সুনাম ছিল এবং আমার বিশ্বাস বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আদর্শ এবং উচ্চমান স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বিরল। পরীক্ষায় সাফল্যের জন্য বা নম্বর বাড়ানোর জন্য কেউ কোনোদিন দরবার করেছে দৃষ্টান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল।

স্যার এএফ রহমান ভাইস চ্যান্সেলরের মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য পদ গ্রহণ করায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদটি খালি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল চ্যান্সেলর অর্থাৎ গভর্নরের কাছে পদে আসীন করার জন্য দুটি নাম প্রস্তাব করে: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রমেশচন্দ্র মজুমদার। হয়তো বিধান রক্ষা করার জন্যই সোহরাওয়ার্দীর নাম দেয়া হয়েছিল। চ্যান্সেলর রমেশচন্দ্রকে পছন্দ করেছেন এবং তাকে নিয়োগ দেয়ার আগে তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে বিনা পারিশ্রমিকে একই সঙ্গে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করবেন। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৪২-এর ৩০ জুন পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠা সততার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করে গেছেন নিয়ে পৃথক নিবন্ধ রচিত হতে পারে।

পাদটীকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষ পূর্তিকালীন ভাইস চ্যান্সেলরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষক একটি নিবন্ধ রচনার ঝুঁকি অনেক, কোনো কথা অপছন্দ হলে মামলা করে দিতে পারেনবিশ্ববিদ্যালয় তার নীতি আদর্শ বিস্মৃত হয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যক্তিমতের প্রকাশ রহিত করতে একটি ফরমান জারি করেছে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ভীষণ লজ্জিত বিব্রত বোধ করেছেন। রমেশচন্দ্রের যুগে ফরমান জারি করে মূর্খতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার নজির কেউ স্থাপন করেননি।

 

. এম  মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন