পর্যালোচনা

অক্সফোর্ডের রূপকথা ও অন্য কথা!

আবু এন. এম. ওয়াহিদ

আজকালকার জামানায় যারা লেখাপড়া করেন, করান এবং নিয়ে ভাবেন, তাদের কাছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় একটি অতি সুপরিচিত নাম। ইংরেজিভাষী দুনিয়ায় এটাই সবচেয়ে পুরনো উচ্চতম বিদ্যাপীঠ। শুধু সময়ের ভারে নয়, গুণে-মানেও অক্সফোর্ড পৃথিবীর একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শত শত বছর ধরে যারা এখানে পড়তে আসেন এবং যারা পড়ান, তারা সবাই না হলেও অনেকেই যে অনন্যগুণের অধিকারী, তার প্রমাণ এখানে সেখানে প্রায় সবখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অক্সফোর্ডের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৭২ জন নোবেল লরিয়েট কোনো না কোনোভাবে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিংবা আছেন। গুণীজনের মিলনমেলায় যেমন আছেন গত শতকের অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, তেমনি আছেন হাল আমলের তরুণী মালালা ইউসুফজাইও। এসব বড় মানুষের ভিড়ে ৫৪ জন আবার সরকারিভাবে অক্সফোর্ডের তালিকাভুক্ত নোবেল বিজয়ী কৃতী ব্যক্তিত্ব। এছাড়া অক্সফোর্ড অ্যালামনাইয়ের মধ্যে রয়েছেন ২৮ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ২০ জন আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি, ১২ জন সেন্ট, একজন স্টিফেন হকিং আরো অসংখ্য বিখ্যাত মানুষ। পৃথিবীর যত বিশ্ববিদ্যালয়ে যত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার কোনোটাই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের সমমানের নয়। জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, প্রকাশনা, সৃষ্টিশীলতা নেতৃত্ব তৈরিতে অক্সফোর্ডের অবদান তার মূল্যায়ন মোটেও আমার রচনার উদ্দেশ্য নয়। শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আজ আমি সম্পূর্ণরূপে অন্য এক গল্পের ঝুলি নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।

বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরনো, তাই বলে এর ইতিহাস -১০ হাজার বছর আগের নয়। তথাপি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, অক্সফোর্ড প্রতিষ্ঠালগ্নের কাহিনী ঘটনাপরম্পরা শুরু থেকেই ঘন ধোঁয়াশায় ঝাপসা হয়ে আছে। কেন এমনটি, এর তাত্পর্যই বা কী, আমি জানি না। বিভিন্ন অনলাইন সূত্র থেকে অক্সফোর্ডের প্রতিষ্ঠাকাল ঘিরে যেসব গল্পগাথা জেনেছি, তাতে আমি বিস্মিত অভিভূত না হয়ে পারিনি! আলোর পর্দায় ভেসে ওঠা এসব বর্ণিল বিবরণের সবই যে ষোলো আনা সহি, সেকথা স্বয়ং লেখকরাও দাবি করেন না। তাহলে কেন এই ধূম্রজাল, কেন রহস্য, সেসব প্রশ্ন থেকেই যায়। মহাকালের কোন মাহেন্দ্রক্ষণে এই ঐতিহাসিক বিদ্যায়তনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেকথা নির্ভুল, সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্টভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। সরকারিভাবে বলা হয়, অক্সফোর্ডের প্রতিষ্ঠাকাল ১০৯৬-১১৬৭ সাল। কোনো নির্দিষ্ট দিন তো নয়ই, এমনকি বছরও নয়, বরং একটি বিশাল বিস্তৃত সময়। কেন এমন, আমি এর একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছি। বলা হয়, ১০৯৬ সালে অক্সফোর্ডের জমিনে কোনো না কোনো তরিকায় এলেম তালিমের আলামত নাকি পাওয়া গেছে। আলামতগুলো আসলে কী, তা জানার বড় খায়েশ ছিল, কিন্তু সে নসিব আমার হয়নি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হয় ১১৬৭ সাল থেকে, যখন রাজা দ্বিতীয় হেনরি বিশেষ রাজনৈতিক বিবেচনায় রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে ইংরেজ ছাত্রদের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নিষিদ্ধ করে দেন। ওই সময় একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী প্যারিস থেকে ফিরে এসে অক্সফোর্ডে ভর্তি হন। অবশ্য এর মানে এই নয় যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডের চেয়ে ভালো কিংবা পুরনো ছিল। অক্সফোর্ডের সূচনালগ্ন হিসেবে এই সন-তারিখই শেষ কথা নয় এবং এগুলো সর্বজনগ্রাহ্যও নয়। নিয়ে আরো অনেক কাহিনী জানা যায়, তবে তাজ্জবের ব্যাপার, এসব মজার মজার খবর তাজা ইতিহাসের পাতায় তালাশ করে পাওয়া যায় না! এজন্য মূলত নির্ভর করতে হয় লৌকিক উপাখ্যানের ওপর। আর এখানেই আমার মনের যত ধন্দ, মনের যত প্রশ্নতৃষ্ণা!

লোকমুখে শোনা কথায় জানা যায়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নাকি বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করে আরো আগে, ৮৭২ সালে যখন ইংল্যান্ডের রাজা মহান আলফ্রেড (King Alfred - the great) অক্সফোর্ডের জমিনে সরজমিনে গিয়ে কিছু খ্রিস্টান পাদ্রির সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং সেখানে ধর্মীয় বিষয়ে তাদের সঙ্গে এক জ্ঞানগর্ভ বাহাসে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যা কিনা জারি ছিল একাধারে বেশ কয়েক দিন। এই লম্বা বাহাসে আলফ্রেড একা ছিলেন, নাকি তার সঙ্গে আরো কেউ সহযোগী ছিলেন, তেমন কোনো ইঙ্গিত আমি কোথাও পাইনি। আলফ্রেড কীভাবে মহান আলফ্রেড হলেন, প্রশ্ন করে আমাকে শরম দেবেন না। বিষয়টি আমার জ্ঞানের পরিধির বাইরে ছিল, বাইরেই আছে।

কারো কারো মতে, অক্সফোর্ডের তরক্কি জোরেশোরে শুরু হয় খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে, যখন নামিদামি অধ্যাপকরা দলে দলে ছাত্রদের পড়াতে এবং একসঙ্গে ক্যাম্পাসে থাকতেও শুরু করেন। মজার ব্যাপার, তখন ছাত্রীদের অক্সফোর্ডে পড়ার কোনো বিধিবিধান ছিল না। মেয়েদের জন্য প্রথমবারের মতো অক্সফোর্ডের দরজা উন্মুক্ত করা হয় ১৮৭০-এর দশকে। তাতেই বা কী, অক্সফোর্ডে পড়ালেখা পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পেলেও তখনো ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেননি। শুনে অবাক হবেন, নারীদের অক্সফোর্ড থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তি শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছর আগে১৯২০ সালে! প্রথম নারী, যিনি গৌরবের জয়মালা গলায় পরেছিলেন, তার নাম অ্যানি মেরি অ্যান হেনলি রজারস।

অতি মুখরোচক অন্য আরেক বয়ানে জানা যায়, তারও আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নাকি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্যাক্সন জাতিগোষ্ঠীর এক পরমা সুন্দরী রাজকুমারী, যিনি হতে চেয়েছিলেন একজন খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী (নান) অবিবাহিতা তরুণীর নাম ছিল ফ্রিডসওয়াইড। চার্চের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়াই ছিল তার জীবনের একমাত্র স্বপ্নসাধ, কিন্তু তার এই মহতী প্রত্যয়ে বাদ সেধেছিলেন এক প্রেমিক রাজা, যিনি তাকে বিয়ে করার জন্য রীতিমতো দিওয়ানা হয়ে গেলেন। কে সেই রাজা, কী ছিল তার নাম? দুঃখের বিষয়, এসব তথ্যও লোকগাথা থেকে আমি হাতিয়ে নিতে পারিনি। তার পরও এই চমকপ্রদ কাহিনী যেভাবে এগিয়ে গেল, তাতে দেখা যায়, খবর পেয়ে বিয়ে পাগলা রাজা রাজকুমারীকে অনুসরণ করে অক্সফোর্ডের দিকে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে মহাপরাক্রমশালী রাজাধিরাজ এক মহাসংকটে পড়ে থমকে দাঁড়ালেন। শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে তিনি আচমকা বুঝতে পারলেনআপাত কোনো কারণ ছাড়া তার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছে! অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না! নিজের পাগলামি বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে রাজা সবিনয়ে মাপ চেয়ে যিশুর জন্য নিবেদিতপ্রাণ সুন্দরী রমণীর কাছে বার্তা পাঠালেন এবং জানালেন, রাজকুমারীকে বিয়ের খায়েশ তার জনমের মতো মিটে গেছে। রাজার প্রার্থনা মঞ্জুর হলো, তিনি অলৌকিকভাবে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে রাজকুমারীর পিছু ছাড়লেন। এরপর অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসে, বর্তমানে যাকে বলে ক্রাইস্ট চার্চ কলেজ, তারই কেন্দ্রবিন্দুতে ফ্রিডসওয়াইড আপন পরিকল্পনামতো একটি  নানারি (নানদের থাকা-খাওয়া উপাসনার নিরাপদ আশ্রয়স্থল) স্থাপন করলেন এবং আপনার কাছে আপন অঙ্গীকার অনুযায়ী বাকি জীবন তিনি সেখানেই কাটিয়ে দিলেন। লোকমুখে শ্রুত কাহিনীর সূত্রমতে, ৭২৭ সালে ওই নানারিতেই ফ্রিডসওয়াইডের মৃত্যু হয়। এতদিন টিকে থাকার পর ১০০২ সালে St. Brice’s Day Massacre-এর সময় নানারিটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। অক্সফোর্ড  ক্যাম্পাসে এই    মহীয়সী নারীকে প্যাট্রন সেইন্ট অব অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি হিসেবে আজও ভক্তি-শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়।

এখানে আমি অক্সফোর্ডের সঙ্গে আরেকটি অতি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আশ্চর্যজনক মিল দেখতে পাই। সেটি হলো মরক্কোর ফেজ বিশ্ববিদ্যালয়। ফেজের ইতিহাস সংক্ষেপে রকমতিউনিসিয়ার কাইরোয়ান শহরের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল ফিহরি নবম শতাব্দীর কোনো এক সময় মরক্কোর ঐতিহাসিক নগরী ফেজে এসে বসতি ব্যবসা শুরু করেন। তিনি মারা গেলে তার সম্পত্তি তার দুই কন্যা মরিয়ম ফাতিমার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। ফাতিমা দেশটির তত্কালীন ইদ্রিসীয় বাদশাহ প্রথম ইয়াহইয়ার অনুমতিক্রমে ৮৫৯ সালে ফেজ শহরে একটি মসজিদ বানান। নারী এতটা ধর্মপ্রাণ ছিলেন যে মসজিদ নির্মাণকালীন পুরো সময়টাই তিনি নফল রোজা রেখে কাটাতেন। মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি মাদ্রাসা, পরে এটাই পরিণত হয় মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক বৈষয়িক বিদ্যাপীঠ হিসেবে। ১৯৬৩ সালে মরক্কো সরকার এটাকে স্টেট ইউনিভার্সিটি সিস্টেম-এর আওতায় নিয়ে আসে এবং আরো দুই বছর পর এর নাম পরিবর্তন করে রাখে আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়। একদিকে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কারাউইনকে পুরো দুনিয়ার প্রথম সনদ প্রদানকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে ইউনেস্কো বিদ্যায়তনকে শুরু থেকেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাদানে সম্মত হয়।

এসব  বিবরণ থেকে দেখা যায়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যেমন আছেন একজন নিঃস্বার্থপর খ্রিস্টান নারী, তেমনি মরক্কোর ফেজ (বর্তমানে আল-কারাউইন) বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আরেকজন আল্লাহভীরু মহীয়সী, যিনি ইতিহাসে ফাতিমা আল-ফিহরি নামে পরিচিত। তবে কাহিনী সূত্রে একটি লৌকিক, আরেকটি ঐতিহাসিক। দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঝে আরো মিল আছে। তবে আমার জানামতে মিলের চেয়ে গরমিলই বেশি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পরে একদিকে ইতিহাস লৌকিকতা মিলেমিশে একেবারে একাকার হয়ে আছে, আবার অন্যদিকে অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসেই অতি উত্কৃষ্ট মানের রূপকথাও সৃষ্টি হয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হলো, অক্সফোর্ড শহর তার নাগরিক সমাজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা দীর্ঘদিনের সহাবস্থান পারস্পরিক  মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এক অনন্যসাধারণ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন, যাকে বলে অক্সফোর্ড সংস্কৃতি এই অভিনব সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এখানে তৈরি হওয়া সুন্দর সুন্দর কিছু গল্পগাথা, যা অক্সফোর্ডের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে আসছে। অক্সফোর্ডের শ্রেণীকক্ষে গবেষণাগারে যেসব বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান জন্ম নেয়, সেগুলো গোটা দুনিয়ার মানুষকে যেমন আলোর পথ দেখায়, তাদের জীবনকে আলোকিত করে, ঠিক তেমনি অক্সফোর্ড শহরে এবং অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসে হাজার বছর ধরে যেসব রূপকথা লোকগাথা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোও জগতের মানুষের হূদয়কে স্পর্শ করে, তাদের অন্তর প্রসারিত করে। আর তাই এসব লোককাহিনী অক্সফোর্ডে আসা দেশ-বিদেশের পর্যটক, অক্সফোর্ড শহরের বাসিন্দা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাই সমানভাবে উপভোগ করেন।

অক্সফোর্ডের লৌকিক উপাখ্যানে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প আছে। আমি আপনাদের জন্য মাত্র দুখানা বেছে নিয়েছি। অক্সফোর্ড সংস্কৃতির সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ উপাদান হলো অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর কাহিনী। রূপকথার গল্প যিনি লিখেছেন তিনি লিউইস ক্যারল নামে পরিচিত, কিন্তু তার আসল নাম ছিল চার্লস লাটউইজ ডজসন। লিউইস ক্যারল অক্সফোর্ডের বিখ্যাত ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। পড়াতে পড়াতে তিনি কলেজের ডিন তার পরিবারের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ডিনের এক মেয়ের নাম ছিল অ্যালিস লিডেল। অ্যালিসের বয়স যখন ১০ বছর তখন তিনি একবার তার বোনদের নিয়ে অধ্যাপক ক্যারলের সঙ্গে আইসিস নদীতে ( নদী বিখ্যাত টেমসের একটি শাখা, যা কিনা অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে প্রবহমান) নৌবিহারে বের হন। সঙ্গে ছিলেন রেভারেন্ড ডাকওয়ার্থ নামে আরেক ভদ্রলোক। নৌবিহারে অ্যালিস অধ্যাপক ক্যারলের কাছে একটি গল্প শোনার আবদার করলেন, তবে অন্যবারের মতো মৌখিক নয়, গল্পটি তিনি লিখিত আকারে চাইলেন। অ্যালিসের জন্য লিউইস ক্যারল যে গল্প লিখলেন, সেটাই হলো কালজয়ী উপাখ্যান Alice’s Adventures in Wonderland, শুরুতে এর শিরোনাম ছিল Alice’s Adventures Under Ground বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। অক্সফোর্ডে অ্যালিসের আরো স্মৃতি আছে। আজও ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে গেলে দেখতে পাবেন, কলেজ গেটের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত একটি দোকান। এর নাম Alice’s Shop’ এটি মূলত একটি মুদি দোকান ছিল। এই দোকানকে অবলম্বন করে লিউইস ক্যারল আরেকটি মনোরম উপাখ্যান সৃষ্টি করে গেছেন। এর নাম Through the Looking-glass, and What Alice Found There (বইটি একাধিক শিরোনামে ছাপা হয়েছে) যেখানে দেখানো হয়েছে, অ্যালিসের দোকানটি পরিচালনা করছে একটি অলৌকিক মেষ। এটি প্রথম ছাপা হয়ে বাজারে আসে ১৮৭১ সালে।

পরের গল্পটি একটু ভিন্ন, তবে সেটিও কম মজার নয়।

অক্সফোর্ডে যখন নতুন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দিতেন তখন তাদের হাতে একটি মোটা ভারী বই ধরিয়ে দেয়া হতো। বইটির প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিল Grey book Grey book- বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় নিয়মকানুন বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। যত জরুরিই হোক না কেন, ছাত্ররা বইটি একেবারেই পড়তে চাইতেন না, তবে এর একটি হাস্যাস্পদ বিকল্প ব্যবহার ছিল। বই দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের ডর্মরুমের দরজা খুলে রাখত। বইটির সরকারি নাম ছিল Grey book কিন্তু ব্যবহারকারীদের মাঝে এর জনপ্রিয় নাম ছিল the Doorstop’ কথিত আছে, বইয়ের এক জায়গায় নাকি লেখা ছিল, সমরসাজে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে যে ছাত্র পরীক্ষার হলে আসবে, তাকে কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এক গ্লাস Sherry (আন্দালুসিয়ায় উত্পন্ন সাদা আঙুরজাত এক ধরনের খানদানি স্প্যানিশ মদ) দেয়া হবে। একবার নাকি এক ছেলে এভাবে সেজেগুজে পরীক্ষা দিতে এসেও ছিল এবং তাকে এক গ্লাস Sherry- দেয়া হয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হলো, একই সঙ্গে বীরবাহাদুর ছাত্রটিকে শিলিং জরিমানাও গুনতে হয়েছিল। কারণ ছেলেটি খাপে গোঁজা তরবারিখানা সঠিকভাবে পোশাকের সঙ্গে বাঁধতে পারেনি।

উপসংহারের বয়ান নিয়ে এবার সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে চলে এলাম মাতৃভূমিতে। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো এবং বড় উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনোভাবে কি কোনো রূপকথা জড়িয়ে আছে? অনেকেই হয়তো বলবেন, না। আমার ধারণা, আছে। আমি যখন কারো মুখে শুনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছিল, তখন আমার কাছে মনে হয়, একক বাক্যই এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে সৃষ্ট সবচেয়ে সুন্দর সার্থক রূপকথার গল্প! আমি কোনো কালে কোনোভাবে ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম বলে দাবি করতে পারি না, তাই আমার কথা ধর্তব্যে না নিলে না- নিতে পারেন। যদি এমনটি হয়, তাহলে পড়ুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র শিক্ষক . তাজ হাশমীর লেখা Was Dhaka University ever ‘the Oxford of the East? লেখাটি ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ছাপা হয়েছে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায়। 


আবু এন. এম. ওয়াহিদ: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন