তিন বছরের মধ্যে ১০০ দেশে পণ্য রফতানি করতে চাই

গত বছরের সেপ্টেম্বরে তালিকাভুক্ত হওয়া ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ এরই মধ্যে বাজার মূলধনের দিক দিয়ে পুঁজিবাজারের দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে আলাপচারিতায় কভিডকালীন ব্যবসা পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তালিকাভুক্তি পরবর্তী অভিজ্ঞতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম মুর্শেদ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত ছবি তুলেছেন মারুফ রহমান

কভিডের কারণে গত বছর ওয়ালটন হাইটেকের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। বর্তমানে মহামারীর দ্বিতীয় প্রবাহ চলছে। অবস্থায় আপনাদের ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?

কভিড এত সহজে দূর হবে না। একে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। গত বছর কভিডের কারণে সরকারের নির্দেশনা মেনে আমরা ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিলাম। তবে সময় আমরা কিন্তু বসে থাকিনি। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। নিজেরাই গগলস ফেস শিল্ড তৈরি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে, হাসপাতাল, ক্লিনিকে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছি। পরে সরকারের নির্দেশনা অনুসারে আমরা আবারো কারখানায় উৎপাদন শুরু করি। গত বছরের তুলনায় বছর কভিডের অভিঘাত আমরা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এখন পর্যন্ত আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি অর্জন করতে পেরেছি। বিশেষ করে চলতি ২০২০-২১ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমাদের ভালো ব্যবসা হয়েছে। আশা করছি সামনের দিনগুলোয় ব্যবসায়িক পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল থাকবে।

কভিডের কারণে মানুষের আয় ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। আপনাদের ব্যবসায় এর কী প্রভাব পড়েছে?

ইলেকট্রনিকস পণ্য বিশেষ করে এসি, টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনএগুলো এখন আর বিলাসবহুল পণ্য নয়, বরং প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। কভিডের কারণে আপনাকে জামাকাপড় আগের তুলনায় বেশি পরিষ্কার করতে হচ্ছে এবং এজন্য ওয়াশিং মেশিনের চাহিদা আরো বেড়েছে। গরমকালে এসি একটি প্রয়োজনীয় পণ্য। কভিডের কারণে মানুষ ঘরে বেশি সময় কাটাচ্ছে। এজন্য টিভির চাহিদা বেড়ে গেছে। কভিডের সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে ঘন ঘন বাজারে যাওয়ার পরিবর্তে একবারে যত বেশি সম্ভব আপনি বাজার করছেন। ফলে এসব পণ্য সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ থাকতে হবে। সব মিলিয়ে মানুষ তার প্রয়োজনেই আমাদের পণ্য কিনছে।

সম্প্রতি ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ছয়টি দেশে কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ। বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ডের মধ্যে জায়গা করে নেয়া। এজন্য আমাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিতে হলে আমাদের বর্তমান যে আয় রয়েছে, সেটি কমপক্ষে আরো তিন গুণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের বাইরে আমাদের আরো নতুন বাজার খুঁজতে হবে। সেজন্যই আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে ভারত, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া চীনে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। সেখানে আমাদের লিয়াজোঁ অফিস থাকবে, বিক্রয় বিপণন বিভাগ থাকবে, গবেষণাও উন্নয়ন বিভাগ থাকবে। তারা সেখানকার ভোক্তাদের চাহিদা অভিরুচি পর্যালোচনা কী ধরনের পণ্যের বাজার রয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের জানাবে। আমরা এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের কারখানা থেকে পণ্য উৎপাদন করে রফতানি করব। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা দেশের কারখানা থেকেই পণ্য তৈরি করে ছয় দেশে পাঠানো হবে। তবে চাহিদা বাড়লে পরবর্তী সময়ে আমরা দেশের বাইরেও কারখানা স্থাপন করব। বর্তমানে ওয়ালটন বিশ্বের ৪০টি দেশে পণ্য রফতানি করছে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে আগামী তিন বছরের মধ্যে আরো ৬০টি দেশে রফতানি করা। সব মিলিয়ে তিন বছরের মধ্যে আমরা ১০০টি দেশে পণ্য রফতানি করতে চাই।

সামনে নতুন কী পণ্য আনতে যাচ্ছে ওয়ালটন?

গবেষণা উন্নয়নের ক্ষেত্রে ওয়ালটন বরাবরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। স্যামসাংয়ের যিনি গবেষণা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি আমাদের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে আমরা একটি ইনোভেশন ল্যাব করেছি। আমরা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টেলিজেন্স টিম তৈরি করেছি। বিষয়ে দু-এক মাসের মধ্যেই আমরা বিস্তারিত জানাব। বর্তমানে আমাদের ১০০টির মতো পণ্য রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এসব পণ্যের আর কী নতুনত্ব নিয়ে আসা যায়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আমাদের ইন্টেলিজেন্স টিম আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর পর কী ধরনের পণ্যের প্রয়োজন হতে পারে, সেটি নিয়ে কাজ করছে। নতুন নতুন উদ্ভাবনের জন্য আমাদের ইন্টেলিজেন্স টিম, ডাটা অ্যানালিটিকস টিম মেশিন লার্নিং টিম একযোগে কাজ করছে। বর্তমানে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো যা উদ্ভাবন করে, আমরা সেটি অনুসরণ করি। আমরা প্রবণতা ভাঙতে চাই।

ওয়ালটনের মোবাইল ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?

দেশে আমরাই প্রথম মোবাইল উৎপাদন কারখানা স্থাপন করি। পরবর্তী সময়ে অন্যরা এগিয়ে এসেছে। এমনকি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোও বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করছে। আমরা মোবাইল উৎপাদন শুরু করেছি বেশিদিন হয়নি। এক্ষেত্রেও আমরা বাজারের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চাই। সেভাবেই আমরা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কাজ করছি।

অটোমোবাইল শিল্প নিয়েও ওয়ালটনের আগ্রহ রয়েছে?

আমাদের পর্ষদে অটোমোবাইল শিল্পে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটি বেশ জটিল সংবেদনশীল শিল্প। ফ্রিজ কিংবা অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের চেয়ে গাড়ি নির্মাণের বিষয়টি তুলনামূলক জটিল। এক্ষেত্রে আমাদের হয়তো বৈশ্বিক কোনো অংশীদারের সহায়তার প্রয়োজন হবে। তবে এক্ষেত্রেও আমরা দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিগণিত হতে চাই।

বর্তমানে ওয়ালটন কী ধরনের পণ্য রফতানি করছে এবং কোন দেশের বাজারে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি হচ্ছে?

টিবি, ফ্রিজসহ সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্যই আমরা রফতানি করে থাকি। এক্ষেত্রে একেক দেশের চাহিদা অনুসারে একেক ধরনের পণ্য রফতানি করা হয়। আমরা বাজারের কথা যদি বলি, তাহলে কভিডের কারণে এখানেও বাঁক দেখা যাচ্ছে। যেমন গত তিন মাস ধরে আমরা ইউরোপের দেশ যেমন রোমানিয়া, গ্রিস জার্মানিতে বড় আকারে শুধু টিভি রফতানি করেছি। এর আগে আমরা ভারতে এসি ফ্রিজ রফতানি করেছি। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যাচ্ছে না যে সামনের দিনগুলোতে রফতানি গন্তব্যগুলোতে বাজার কীভাবে আচরণ করবে?

সম্প্রতি আপনাদের একজন পর্ষদ সদস্য নিজের স্বতন্ত্র একটি ব্যবসা শুরুর উদ্যোগ নিয়েছেন

তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে এবং পরের ওয়ালটনের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য রয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে বর্তমানে পর্ষদ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আলাদা করা আছে। ওয়ালটনের সি টাইপ শীর্ষ কর্মী যারা রয়েছেন, আমার নেতৃত্বে তারা কোম্পানির প্রাত্যহিক কাজ দেখভাল করছেন। পর্ষদ তাদের অবস্থান থেকে কোম্পানির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। প্রয়োজন হলে তারা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে থেকে কোম্পানির অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখছেন। আমাদের যেই পর্ষদ সদস্যরা তাদের মেধা যোগ্যতার মাধ্যমে আজকের ওয়ালটন গড়ে তুলেছেন, তারা যদি নতুন কোনো ব্যবসার উদ্যোগ নেন, তাহলে আমি মনে করি এটি ইতিবাচক। কারণ এতে ওয়ালটনের মতো নতুন আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এটি দেশের অর্থনীতি ব্যবসার জন্য ইতিবাচক বলে আমি মনে করি।

তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এক বছরেরও কম সময়ে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের বাজার মূলধন ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীদের কারণেই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছে ওয়ালটন। বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিদান দিতে আপনারা কতটা দায়বদ্ধ?

পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের ওয়ালটনের ওপর আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। তাদের আস্থার কারণেই আমরা আজকে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছি। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকেই আমরা কোম্পানি আয় মুনাফা বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছি। এমনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছি, যাতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়। এক্ষেত্রে আমরা যত বেশি সম্ভব মুনাফা অর্জন করে এর বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় লভ্যাংশ দিতে চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন