লন্ডনে থিতু হচ্ছে ইস্পাহানি পরিবার

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

মির্জা আলী বেহেরুজ ইস্পাহানির প্রয়াণ ঘটে ২০১৭ সালে। এরপর বাংলাদেশে ইস্পাহানিদের ব্যবসার হাল ধরেন তার ভাই মির্জা সালমান ইস্পাহানি। চার বছর ধরে ইস্পাহানি গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আরেক ভাই মির্জা সাকির ইস্পাহানি নিয়োজিত রয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন সবার বড় ভাই মির্জা সাজিদ ইস্পাহানি। আরেক ভাই মির্জা ইমরান ইস্পাহানিও লন্ডনে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের কেউই বর্তমানে দেশে নেই। ইস্পাহানিদের এখানকার বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য বর্তমানে তারা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ পরীক্ষিত  কর্মী ব্যবস্থাপকদের ওপরই নির্ভর করছেন বেশি।

ইস্পাহানি পরিবারের নবীন প্রবীণ প্রজন্মের সদস্যরা এখন বছরের অধিকাংশ সময় লন্ডনেই অতিবাহিত করেন। সেখানে দ্বিতীয় আবাস গড়ে তুলেছেন তারা। নিকটজনরা মনে করছেন, এর পেছনে তাদের ব্যবসায়িক কোনো সুদূরপ্রসারী চিন্তা থাকলেও থাকতে পারে।

পাকিস্তান আমলের সবচেয়ে ধনী ২২ পরিবারের অন্যতম ইস্পাহানি পরিবার। ওই সময়ে পরিবারের ব্যবসা দেখভাল করতেন মির্জা সাদরি ইস্পাহানি। স্বাধীনতার পর সম্পদশালী অন্য প্রায় সব পরিবার পাকিস্তানে চলে গেলেও বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বাংলাদেশে থেকে যান সাদরি ইস্পাহানি। তার সন্তানেরাই বর্তমানে ইস্পাহানি গ্রুপের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ইস্পাহানি গ্রুপসংশ্লিষ্টরা জানান, সাদরি ইস্পাহানির সন্তানরা বয়সে প্রবীণ হয়ে পড়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত পরিবারের নতুন প্রজন্মের কেউ বড় কোনো দায়িত্বশীল কাজে নিয়োজিত হননি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বিশ্বস্ত, দক্ষ পরীক্ষিত কর্মীদেরই বড় দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন তারা। সাদরি ইস্পাহানির এক সন্তান আগে থেকেই পাকাপাকিভাবে লন্ডনে বসবাস করছিলেন। তার অন্য সন্তান তাদের উত্তরসূফররাও বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় সেখানেই থাকেন। গ্রীষ্ম মৌসুমে পরিবারের কেউই বাংলাদেশে থাকেন না। প্রতি বছর জুন-জুলাইয়ে লন্ডনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইস্পাহানি পরিবারের সদস্যদের একত্র হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বর্তমানে পরিবারের একজন সদস্যও বাংলাদেশে নেই।

মির্জা সাদরি ইস্পাহানির প্রয়াণের পর গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় সন্তান মির্জা আলী বেহেরুজ ইস্পাহানি। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। বর্তমানে তার স্ত্রী মির্জা জাহেদা ইস্পাহানি গ্রুপের পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।

মির্জা সাদরি ইস্পাহানির জ্যেষ্ঠ পুত্র মির্জা সাজিদ ইস্পাহানি একজন অবসরপ্রাপ্ত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই পুত্র এক কন্যাসন্তানের জনক। তার দুই ছেলে মির্জা আলী ইস্পাহানি মির্জা হাসান পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। সম্প্রতি তারা দেশের ব্যবসায় মনোনিবেশ করছেন। তাদের মধ্যে একজন ঢাকায় অন্যজন চট্টগ্রামে ব্যবসা দেখছেন।

তৃতীয় ভাই মির্জা ইমরান ইস্পাহানি লন্ডনেই থাকেন। বিদেশে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড দেখভাল করেন তিনি। চতুর্থ ভাই মির্জা সালমান ইস্পাহানির তিন সন্তান। এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলে মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি লন্ডন থেকে পড়াশোনা করে দেশের ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তবে সম্প্রতি তিনি ফের লন্ডনে ব্যবসা প্রশাসনে এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের জন্য চলে গেছেন। মেয়েদের দুজনই লন্ডনে পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই বসবাস করছেন। সবার ছোট ভাই মির্জা সাকির ইস্পাহানির একমাত্র কন্যাসন্তানও লন্ডনে পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই বসবাস করছেন।

ইস্পাহানি পরিবার দেশে ব্যবসা করছে দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি আর্থিক খাতের লেনদেনেও খুবই ইতিবাচক স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রেখেছে ইস্পাহানি গ্রুপ। তবে মুহূর্তে দেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ওপরই নির্ভর করছে পরিবারটি। নিকটজনদের ভাষ্যমতে, তাদের নতুন প্রজন্মের এখানকার পরিবেশ নতুন ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, বর্তমান ভবিষ্যৎ সামাজিক স্থিতিশীলতার বিষয়গুলোও সুদূরপ্রসারী জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে পরিবারটি। কারণে সক্ষমতা সত্ত্বেও দেশে সাম্প্রতিক কালে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগে যায়নি তারা। দক্ষ কর্মী বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের চেনা গণ্ডির মধ্যেই ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। নিজেরা মনোনিবেশ করছে পড়াশোনা চাকরিতে।

বিষয়ে জানতে চাইলে ইস্পাহানি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক ওমর হান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ইস্পাহানি পরিবারের নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগই এখন দেশের বাইরে পড়াশোনা করছেন। ব্যবসা পরিচালনার জন্য তারা দীর্ঘদিনের পুরনো কর্মীদেরই দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। পুরনো পরীক্ষিত কর্মীরা যথাযথভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান ব্যবসা চা উৎপাদন মোড়কজাত করা। দেশের শীর্ষস্থানীয় চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছে প্রথম সারির কয়েকটি চা বাগান মির্জাপুর, জেরিন, নেপচুন গাজীপুর। চা মোড়কজাত ব্র্যান্ডিংয়ে এখন পর্যন্ত শীর্ষে রয়েছে গ্রুপটি। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত চা দেশের বাজারে বিক্রি হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নিলামের মাধ্যমেও বিপণন হয়।

টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিটিএবি) চেয়ারম্যান পদে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য রয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপের। আগে সংস্থাটির দুই বছর মেয়াদি চেয়ারম্যান পদে ইস্পাহানি পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে গ্রুপের চা বিভাগের কর্মীদেরই গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নিতে দেখা যাচ্ছে বেশি। পরিবারের সর্বশেষ সদস্য হিসেবে পদে দায়িত্ব পালন করেছেন মির্জা সালমান ইস্পাহানি। তারপর দায়িত্ব পালন করেছেন চা বিভাগের প্রধান নির্বাহী শান্তনু বিশ্বাস। তিনি মারা যাওয়ার পর টি ট্রেড বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শাহ মাঈনুদ্দিন হাসান বর্তমানে টি সেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. ওমর হান্নান দায়িত্ব পালন করছেন। বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে অনেকেই বলছেন, ইস্পাহানি পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে বড় দায়িত্ব গ্রহণ থেকে ক্রমেই সরে আসছেন। 

বর্তমানে বাংলাদেশে ইস্পাহানি গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশিতে। গত দুই দশকে দেশে ভারী শিল্পে বিনিয়োগে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। তবে এর মধ্যেও বিনিয়োগে লাগাম টেনে ধরেছে বনেদি শিল্প পরিবার ইস্পাহানি গ্রুপ। সময় নতুন খাতে বিনিয়োগ থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে পরিবারটি। কৃষি, খাদ্য, প্যাকেজিং, হোটেল অবকাশসহ রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের ব্যবসায়িক পরিধি। এক সময় পাট টেক্সটাইলে আধিপত্য থাকলেও শিল্প দুটিতে নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না ইস্পাহানি গ্রুপ। বরং পুরনো ব্যবসাগুলোতেই নিজেদের মনোযোগ ধরে রেখেছে পরিবারটি।

সাম্প্রতিক সময়ে গ্রুপটি খাদ্য আনুষঙ্গিক খাতের ব্যবসাকে সম্পূর্ণ অটোমেশনের আওতায় নিয়ে এসেছে। এজন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া ২০২০ সালের শেষ দিকে দিনাজপুরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে অটোমেটিক রাইস মিল স্থাপন করে ইস্পাহানি গ্রুপ। পাশাপাশি সামিট গ্রুপের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভিক্টোরি জুট মিলসের জমিতে আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে। এছাড়া প্যাকেজিং শিল্পেও ব্যবসার পরিধি বিস্তৃত করছে প্রতিষ্ঠানটি। মূলত চায়ের পাশাপাশি এগ্রো, বীজ খাদ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ালেও অন্য কোনো ভারী শিল্পে ইস্পাহানি পরিবারকে বিনিয়োগ করতে দেখা যায়নি।

গ্রুপটির দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রুপের ব্যবসায়িক ফোরামে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো এবং নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব আসে। কিন্তু কর্ণধাররা এসব প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তাদের ভাষ্য, যে ব্যবসায় তাদের অভিজ্ঞতা নেই, সেখানে তারা বিনিয়োগ করবে না। বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্যবসাকে আরো বাড়ানোর প্রতিই বেশি মনোযোগী শিল্প গ্রুপটি।

ঢাকায় ইস্পাহানি গ্রুপের সবচেয়ে বড় ভূসম্পত্তি ছিল মগবাজারে। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে আবাসন খাতের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে জমি বাণিজ্যিকভাবে উন্নয়নের জন্য দিয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপ। এবিসি রিয়েল এস্টেট নামে ওই প্রতিষ্ঠান সেখানে ইস্পাহানি কলোনির জন্য বৃহৎ পরিসরে নয়টি কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করছে। দি ওয়েসিস অ্যাট ইস্পাহানি কলোনি নামে অভিহিত প্রকল্পের ফ্ল্যাট বিক্রি কার্যক্রমও চলছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন