পাঁচ বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ প্রত্যাবাসন করেছে ৬ প্রতিষ্ঠান

মেহেদী হাসান রাহাত

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসা করছে চার বহুজাতিক টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক এয়ারটেল। বৈশ্বিক টেক জায়ান্ট ফেসবুক গুগলেরও পদচারণা বাড়ছে এক দশক ধরে। ছয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসার বিপরীতে দেশের বাইরে গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রায় ১৯২ কোটি ডলার প্রত্যাবাসন করেছে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি (ডলারপ্রতি ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা হিসাবে) এর মধ্যে গ্রামীণফোন এককভাবে প্রত্যাবাসন করেছে ১১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০১৬-২০ পর্যন্ত পাঁচ বছর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে মোট ১৯১ কোটি ৯৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার বা ১৬ হাজার ২৭৬ কোটি ৩২ হাজার টাকা প্রত্যাবাসন করেছে ছয় প্রতিষ্ঠান। টেলিযোগাযোগ খাতের তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন সময়ে প্রত্যাবাসন করেছে ১৩৬ কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার বা ১১ হাজার ৬১৪ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে ২২ কোটি লাখ ৬০ হাজার ডলার, ২০১৭ সালে ২৫ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৮ সালে ২৮ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার, ২০১৯ সালে ২১ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার ২০২০ সালে ২৪ কোটি ৬৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার বিদেশে প্রত্যাবাসন করেছে। আর চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে প্রত্যাবাসন হয়েছে ১৪ কোটি ২৫ লাখ ১০ হাজার ডলার।

গত বছর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া টেলিযোগাযোগ খাতের বহুজাতিক কোম্পানি রবি আজিয়াটা সাড়ে পাঁচ বছরে ১৯ কোটি লাখ ৯০ হাজার ডলার বা হাজার ৬১২ কোটি ৮১ লাখ ১২৩ হাজার টাকা প্রত্যাবাসন করেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে কোটি ৭৬ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে কোটি ৬৯ লাখ ৯০ হাজার, ২০১৮ সালে কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার, ২০১৯ সালে কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ২০২০ সালে কোটি ২৮ লাখ ১০ হাজার ডলার প্রত্যাবাসন করেছে কোম্পানিটি। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে সময়ে রবি আজিয়াটার প্রত্যাবাসন করা অর্থের পরিমাণ ৪১ লাখ ৩০ হাজার ডলার।

গ্রাহকসংখ্যায় তৃতীয় বৃহত্তম সেলফোন অপারেটর বাংলালিংক গত সাড়ে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৪ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার ডলার বা হাজার ২০৯ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা বিদেশে প্রত্যাবাসন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে কোটি ২৭ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার, ২০১৮ সালে কোটি ৩৭ লাখ ২০ হাজার, ২০১৯ সালে কোটি ৫৫ লাখ ১০ হাজার ২০২০ সালে কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিদেশে প্রত্যাবাসন করেছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে কোম্পানিটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার প্রত্যাবাসন করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রবি আজিয়াটার সঙ্গে একীভূত হওয়া এয়ারটেল ২০১৬ সালে ১৫ কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার বা হাজার ২৯৩ কোটি লাখ হাজার টাকা প্রত্যাবাসন করেছিল। তবে একীভূতকরণের পর থেকে দুই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাবাসিত অর্থ একই সঙ্গে হিসাব করা হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের প্রচারণার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলো ফেসবুককে অর্থ পরিশোধ করে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে ফেসবুক বাংলাদেশ থেকে কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার বা ২৬৬ কোটি ১৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা প্রত্যাবাসন করেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে লাখ ৮০ হাজার ডলার, ২০১৭ সালে ১৮ লাখ ৬০ হাজার, ২০১৮ সালে ৪১ লাখ ১০ হাজার, ২০১৯ সালে ৭৯ লাখ ৭০ হাজার ২০২০ সালে ৯৭ লাখ ১০ হাজার ডলার প্রত্যাবাসন করেছে ফেসবুক। আর বছরের জানুয়ারি থেকে মে সময়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যাবাসিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার। গত বছর এইচটিটিপুলকে বাংলাদেশে তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ফেসবুক। এর আগের বছরগুলোতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফেসবুক বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

গুগল গত সাড়ে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ২৮০ কোটি ৯৬ হাজার টাকা দেশের বাইরে প্রত্যাবাসন করেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে লাখ ৭০ হাজার, ২০১৭ সালে ১৩ লাখ ২০ হাজার, ২০১৮ সালে ৪০ লাখ ১০ হাজার, ২০১৯ সালে ৮৮ লাখ ৯০ হাজার ২০২০ সালে কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশ থেকে ৬৫ লাখ ডলার বিদেশে প্রত্যাবাসন করেছে গুগল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশে ব্যবসা করে দেশে অর্থ নিয়ে আসছে। একইভাবে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিপরীতে আয়ের অর্থ বিদেশে প্রত্যাবাসন করছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনকানুন কর পরিশোধ করেই প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাইরে অর্থ পাঠাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা থেকে যে আয় করছে তার একটি অংশ তাদের মূল প্রতিষ্ঠানের কাছে লভ্যাংশ হিসেবে পাঠাচ্ছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম-নীতি কর পরিশোধ করে বৈধ মাধ্যমেই অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে। অন্যদিকে গুগল ফেসবুকের পরিধি অনেক বিস্তৃত। ফলে দুই মাধ্যমে কী পরিমাণ বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কিংবা প্রকৃতপক্ষে তাদের আয়ের পরিমাণ কত, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনতে কাজ করছে।

গত সপ্তাহে এনবিআরের কাছ থেকে মূল্য সংযোজন করের (মূসক) নিবন্ধন নিয়েছে ফেসবুক। এর আগের মাসে গুগলও মূসক নিবন্ধন নিয়েছে। ফলে এখন থেকে ফেসবুক গুগলের ঘোষিত লেনদেনের ওপর সরকার নির্ধারিত হারে মূসক পরিশোধের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান দুটিকে নিয়মিত এনবিআরের কাছে মূসক রিটার্ন দাখিল করতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা কত সেটিও এর মাধ্যমে জানা যাবে। ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় করলেও এর বিপরীতে সরকারকে যথাযথভাবে কর না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। দেশে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় কার্যালয় না থাকায় করজাল কিংবা আইনি দায়বদ্ধতার মধ্যে তাদের কতটুকু আনা সম্ভব সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে খাতসংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বাজারের বড় একটি অংশ আসে টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। ডিজিটাল মাধ্যম প্রসারের ফলে টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করছে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে। ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি নিয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিলে উচ্চ আদালতে একটি রিট দায়ের করা হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছিল, গত পাঁচ বছরে তিনটি বেসরকারি সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি বাংলালিংক অনলাইন বিজ্ঞাপন বাবদ হাজার ৭৪৪ কোটি ১৯ লাখ হাজার ৭৩ টাকা খরচ করেছে। বিজ্ঞাপন প্রচার বাবদ ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইমো হোয়াটসঅ্যাপ অর্থ আদায় করেছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোন ৪৩ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার ৬২৯ ডলার, রবি ৩২ কোটি ১৩ লাখ ৩৮ হাজার বাংলালিংক ২৮ কোটি ৬৪ লাখ ৬৯ হাজার ৯৬৭ ডলার ব্যয় করেছে।

গত বছরের নভেম্বরে উচ্চ আদালত রিটের রায়ে ফেসবুক গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধন করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে কত টাকা পাওয়া যাচ্ছে তা ছয় মাস অন্তর আদালতকে জানানো নির্দেশ দিয়েছেন। মূলত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই সম্প্রতি ফেসবুক, গুগল অ্যামাজন মূসক নিবন্ধন করেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন