জ্বালানি সংকটেও চলছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ

আবু তাহের

দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। অন্যদিকে কমে আসছে গ্যাসের মজুদ। সংকট মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হলেও তা দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। সংকটের এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আমদানীকৃত এলএনজি দেশে উত্তোলিত গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতাসম্পন্ন আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে বেশ কয়েকটির নির্মাণ কার্যক্রম প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস সংযোগের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা নেই। আমদানীকৃত এলএনজি দিয়েই আগামীতে শিল্প বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু আমদানীকৃত গ্যাসে যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয় তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পুনরায় ভর্তুকি দিলে রাজস্ব ক্ষতির মধ্যে পড়বে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে গ্যাসভিত্তিক পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা হাজার ২০০ মেগাওয়াট। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিডিবি ইলেকট্রিক পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। গ্যাস এলএনজিভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্রুতই উৎপাদনে যাবে।

এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে আরো অন্তত তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। এগুলো হলো ইউনিক গ্রুপের ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড ৫৮৪ মেগাওয়াট। সামিট পাওয়ারের ৫৮৩ মেগাওয়াট এবং ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স পাওয়ারের ৭৫০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে এসব কোম্পানি প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি জ্বালানি তেলের উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু দেশে বর্তমানে চালু থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে যথাযথ গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। গ্যাসের সংকট থাকলে তেল চালিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, গ্যাসের সংকটে দেশে বর্তমানে আড়াই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতাসম্পন্ন বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। জ্বালানির অন্যান্য উৎসের তুলনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় তিন-চার বছর আগে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু অব্যাহতভাবে গ্যাসের উৎপাদন কমে আসায় এবং আমদানীকৃত এলএনজির আমদানি আগের মতো থাকায় এসব কেন্দ্রে গ্যাসের সংস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা।

পেট্রোবাংলার দৈনিক উৎপাদন চিত্র অনুযায়ী, দৈনিক হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানীকৃত এলএনজি। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা রয়েছে হাজার মেগাওয়াটের মতো। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি মেটাতে না পারায় গ্যাসভিত্তিক বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

অন্যদিকে, আমদানীকৃত এলএনজির সরবরাহ ব্যাহত হলে শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রায়ই গ্যাস সংকটে পড়ছেন রাজধানীর আবাসিক সংযোগের গ্রাহকরা। শিল্প মালিকদের অভিযোগ, কারখানায় ১৫ পিএসআর গ্যাসের চাপের কথা থাকলেও তা কখনো - পিএসআরে নেমে আসছে। এর বাইরে অবৈধ লাইনের মাধ্যমে চুরি হচ্ছে মোটা অংকের গ্যাস। এমন অবস্থায় জ্বালানি আমদানির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকলে প্রস্তুত হওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক . তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি খাতে মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো গ্যাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। গ্যাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত না করে পূর্বানুমানের ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দিলে সেটার পরিকল্পনায় ভুল হবে। হচ্ছেও তাই। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত হলেও জ্বালানি সরবরাহ করা না গেলে কেন্দ্র বসে থাকবে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। গ্যাসের অনুসন্ধান কিংবা আমদানিতে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের, যে কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

তবে আগামীতে আমদানি করা এলএনজিতে জ্বালানি সরবরাহ প্রাধ্যান্য দেয়া হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে এলএনজির বেজ টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে আমদানি বাড়ানো হবে। এতে একদিকে যেমন এলএনজি প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে ঘাটতি কমে আসবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি জোগাতে আমরা এলএনজি আমদানি করছি। এটি পর্যায়ক্রমে আরো বাড়বে। এছাড়া দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে দেশে একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা জেগেছে। এখান থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যেতে পারে।

এদিকে গত মৌসুমে এলএনজি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় গ্রীষ্ম সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেয়। গ্যাস সংকটে দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। আমদানীকৃত এলএনজির বাজার অস্থির থাকায় স্পট মার্কেট থেকে পণ্যটি কিনতে পারেনি জ্বালানি বিভাগ। ফলে গ্যাস সংকটে নাস্তানাবুদ হতে হয় রাজধানীর আবাসিক গ্রাহকদের। গ্যাসের চলমান এসব সংকটে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ক্ষতিতে ফেলবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। অন্যদিকে বছরের পর বছর ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে হবে পিডিবিকে।

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, নতুন করে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি হয়নি। যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলো আগের। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র আগেই নির্মাণ অনুমোদন পেয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন