পর্যালোচনা

মহামারী মোকাবেলার বাজেট ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

করোনা মহামারী দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজসহ সচেতন মহলের প্রত্যাশা ছিল আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় পর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং খরচের পরিকল্পনাসহ সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকবে। সংকট উত্তরণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি খাতে বাজেট বৃদ্ধির নানা পরামর্শ বাজেট-পূর্ব আলোচনা লেখালেখিতে উঠে এসেছে।

নিঃসন্দেহে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলও বিষয়ে সচেতন। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, তথা জীবন জীবিকাকে গুরুত্ব দিয়ে এবার স্মরণকালের বৃহত্তম বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ

কভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ভোগ চাহিদা, স্থানীয় উৎপাদন সরবরাহ ব্যবস্থায় স্থবিরতা নেমে আসে। আমদানি-রফতানি কমে যায়। এতে সরকারের রাজস্ব আহরণেও ধস নামে। রাজস্ব আহরণের নেতিবাচক প্রভাব আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরেও অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য আয় বৃদ্ধির চেয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধির দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ স্থবির বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য সরকারি ব্যয়ের বিকল্প নেই।

উপরিউক্ত বাস্তবতায় আগামী বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে লাখ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭ দশমিক শতাংশ। বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির দশমিক শতাংশ। স্মর্তব্য যে বাজেটে আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার অনুমান করা হয়েছে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এবারই তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে বড় ঘাটতির বাজেট। সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে জনপ্রশাসনে। খাতে বরাদ্দের পরিমাণ লাখ ৮৫ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিক্ষা প্রযুক্তি খাত। খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৫ দশমিক শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গত বছরের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে লাখ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তবে খাতের বরাদ্দের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি যাবে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। করোনা মোকাবেলায় খাতে আরো ১০ হাজার কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

কৃষি পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ৭৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা, এর মধ্যে শুধু কৃষি খাতে বরাদ্দ আছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হবে হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে কেউ কেউ হিসাব কষে দেখিয়েছেন টাকার অংকে বরাদ্দ বেশি হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খাতে জিডিপির অনুপাতে এবারের বাজেটে গত অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে। বাজেটের বিস্তারিত বরাদ্দ উল্লেখ না করেও একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন, বরাদ্দ বাড়তি বা কমতি যা- হোক কোনো বছরই মন্ত্রণালয়গুলো বরাদ্দকৃত বাজেটের সবটা খরচ করতে পারে না। গড়ে ২০-২২ শতাংশ অব্যয়িত থেকে যায়। অর্থবছরের শেষ দিকে অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত বাজেট প্রস্তুত করতে হয়।

বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর তত্কালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম যে বাজেট ঘোষণা করেন তার আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। সে তুলনায় এবারের বাজেট প্রায় ৭৬৮ গুণ বড়। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি বাজেট বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ, অর্থ বরাদ্দ কোনো সমস্যা নয়।

ঘোষিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ দেখানো হয়েছে লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রভৃতি ১০টি বড় প্রকল্পে বরাদ্দ প্রস্তাবিত হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। টাকার অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, আজকাল এমনটি দেখা যায় না। বরং প্রকল্পের পূর্ত কাজ, কেনাকাটা ইত্যাদির টেন্ডার আহ্বান ঠিকাদার নির্বাচন এবং চালু প্রকল্পের বিভিন্ন উপাঙ্গের কাজ ঠিকমতো করতে না পারার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। ফলে বরাদ্দকৃত বাজেটের কিছু অংশ অব্যয়িত থাকে।

সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ সম্ভাব্য খরচের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বাজেট-পরবর্তী আলোচনা বেশি হচ্ছে। বর্তমানে ১২৩টি কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ৩০টি মন্ত্রণালয় বিভাগ এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে চালু ১১২টি উপজেলার সঙ্গে নতুন করে ১৫০টি উপজেলার বয়স্ক, বিধবা স্বামী নিগৃহীতা নারীকে ভাতার আওতাভুক্ত করা হবে। চলতি বছরে ৪৯ লাখ বয়স্ক, ২০ লাখ ৫০ হাজার বিধবা স্বামী নিগৃহীতা নারী ১৮ লাখ প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হবে লাখ ৪০ হাজার ৯০০ জন বয়স্ক, লাখ ৯২ হাজার ৩৩৪ জন বিধবা স্বামী নিগৃহীতা নারী সাড়ে চার লাখ প্রতিবন্ধী। তবে করোনা মহামারীর কারণে কর্ম হারানো প্রায় আড়াই কোটি নতুন দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কী ব্যবস্থা রয়েছে তা বাজেটে স্পষ্ট নয়। অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ থিংকট্যাংক বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কর্মহীন দরিদ্র লোকের নগদ সহায়তার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার কর্মসূচি জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে, যাতে কেউ অনাহারে না থাকে।

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি বাজেট বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতার জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৯৮ হাজার ৮৪০ কোটি  টাকা, যা সংশোধিত বরাদ্দের ৪৯ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের প্রধান উৎস এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি বছরের লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বিগত বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা কোনো বছরই অর্জিত হয় না। করোনা মহামারীর কারণে আগামী অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ বাবদ ধরা হয়েছে লাখ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ বাবদ লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে রাজস্ব সংগ্রহে ঘাটতি হলে ঋণ আরো বাড়বে।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে লাখ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। তথাপি বছর শেষে প্রকৃত অর্জন ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হতে পারে।

আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মতো অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন আমদানি রফতানি, ভোগ্যদ্রব্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা সরবরাহ, প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি প্রভৃতি ফিরে আসবে কিনা তা নির্ভর করছে করোনা মহামারীর গতিপ্রকৃতির ওপর। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাঙ্ক্ষিত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং নীতি বাস্তবায়নের সামর্থ্য সময়ের স্বল্প পরিসরে অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।

এবার বাজেটের শুল্ককর-সংক্রান্ত পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করা যাক। বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের ঊর্ধ্ব বা নিম্নমুখী প্রবণতা, দ্রব্যমূল্য প্রভৃতি অনেকটা নির্ভর করে বাজেটে শুল্ককর নির্ধারণের দক্ষতার ওপর। সর্বোপরি রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও শুল্ককর নির্ধারণের প্রভাব অনস্বীকার্য।

প্রস্তাবিত বাজেটের রাজস্ব নীতি পুরোটাই ব্যবসাবান্ধব হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাজেট প্রস্তুতির প্রাক্কালে দেশের কর ব্যবস্থা নিয়ে শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়ী নেতাদের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। কথিত ব্যবসা বৈরী কর ব্যবস্থার কারণে একজন শীর্ষ উদ্যোক্তা কান ধরে ব্যবসা ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। আর একজন ব্যবসায়ী নেতা মন্তব্য করেছেন, দেশে কী মধু আছে যে ৩২ শতাংশ করপোরেট কর দেব খবরের কাগজে আরো দেখেছি, বিনিয়োগে কেউ কেউ ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধা চেয়েছেন। দেশে অগ্রিম কর দেয়ার বিধান চালুর পর কর আহরণে যেমন বৈপ্লবিক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল, তেমনি কর ফাঁকি বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী অগ্রিম কর প্রথা বিলোপের কথা বলেছেন।

যাবৎ দেশে যে কর কাঠামো বিরাজমান ছিল তার মধ্য থেকেই দেশে বহু ছোট-বড় উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে, বিনিয়োগ বেড়েছে, রফতানি বেড়েছে। বলতে গেলে অনেক কোটিপতিও জন্মেছে। এর কারণ অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ রফতানিতে প্রচুর শুল্ককরে ছাড় নীতিসহায়তা। উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণে কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের মুনাফা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর ওপর কারো কারো কর ফাঁকির প্রবণতাও  উড়িয়ে দেয়া যায় না।

যা হোক, অর্থমন্ত্রী এবার উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের অনেক আকাঙ্ক্ষাই পূরণ করেছেন। পরপর দুই বছর আড়াই শতাংশ হারে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটেও আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমানো হয়েছিল। অর্থাৎ কয়েক বছরের ব্যবধানে দশমিক শতাংশ করপোরেট কর কমেছে। এবার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করও দশমিক শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে যে পরিমাণ কর কম পরিশোধ করতে হবে তা কোম্পানির লভ্যাংশে যুক্ত হবে।

আশা করা হয়েছে, এর ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং ফলে রাজস্ব বাড়বে।

মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিংয়ের আওতায় নতুন উদ্যোগে ১০ বছরের করছাড় দেয়া হবে। আরো আছে, ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহর বাদে অন্যত্র হাসপাতাল নির্মাণে ১০ বছরের করছাড়। অটোমোবাইল, থ্রি হুইলার, ফোর হুইলার উৎপাদনকারী কোম্পানিকে শর্ত সাপেক্ষে ১০-২০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে।

দেশে ইলেকট্রনিকস দ্রব্যাদি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, মোবাইল ফোন প্রভৃতি প্রস্তুতে কর ভ্যাট ছাড় আরো ১০ বছর বাড়ানো হয়েছে।

ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, -লার্নিং প্লাটফর্ম, -বুক প্রকাশনা, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস এবং আইটি ফ্রিল্যান্সিং সরবরাহকারীদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত করছাড়ের সুবিধা দিয়ে ডিজিটাল রূপান্তর প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে।

তবে প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) ওপর করহার ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ ধার্য করায় এমএফএস ব্যবহারকারী নিম্নবিত্তের মানুষের ওপরই করভার স্থানান্তরিত হবে বলে ধারণা করা যায়। বাজেট পাসের সময় বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এক ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিকে উৎসাহিত করতে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। ধরনের কোম্পানির করপোরেট কর ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। দেশে তৈরি রড সিমেন্টের উৎসে কর শতাংশ থেকে কমিয়ে শতাংশ করা হয়েছে।

পাইকারি ব্যবসায়, পণ্য পরিবেশক ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের ওপর দশমিক ৫০ শতাংশ অগ্রিম কর ধার্য রয়েছে। এটি কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে মোবাইল অপারেটর তামাক প্রস্তুতকারক কোম্পানির কর ভ্যাট হার পূর্ববত বহাল থাকবে।

কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে কর ছাড় আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। দেশীয় শিল্প বিকাশে বিদ্যমান ভ্যাট আইন আরো ব্যবসাবান্ধব করার জন্য ব্যাপক ছাড় দেয়া হয়েছে। আমদানি দ্রব্যে আগাম কর শতাংশ থেকে কমিয়ে শতাংশ করা হয়েছে। ভ্যাট ফাঁকির জরিমানাও কমানো হয়েছে। ইলেকট্রনিকস শিল্পের এয়ারকন্ডিশনার রেফ্রিজারেটর এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স সামগ্রী উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।

১৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বেশকিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্য কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

ভারী শিল্প, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প আইটি খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাপক ভ্যাট শুল্ক সুবিধা দেয়া হয়েছে।

নানা ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক সুষম করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনকে সংরক্ষণের জন্য বিদেশী মোবাইল ফোন আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। দেশী খামারিদের প্রোটেকশনের জন্য আমদানীকৃত গুঁড়া দুধের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। দেশীয় ফলফলাদি সবজির সুরক্ষার জন্য আমদানীকৃত ফল কিছু সবজির শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। মুরগি মাছের খাবারের উপকরণের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে।

মাইক্রোবাস আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। করোনা ক্যান্সারের প্রতিষেধক ওষুধ ওষুধের কাঁচামাল এবং চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে শুল্ক ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে।

ওপরের বর্ণনা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এবারের বাজেটে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ সুবিধা অবারিত করা হয়েছে। সরকার আশা করছে, উদ্যোক্তারা নানা সুবিধা গ্রহণ করে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান হবে। এখন দেখার বিষয় হলো উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা তাদের পক্ষ থেকে কাঙ্ক্ষিত কাজটি করেন কিনা। কর কমানোর ফলে মুনাফা বাড়বে। শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়লে বাজারে ভোগ চাহিদা বাড়ার কথা। এটি যদি না হয় তবে দেশে আয়বৈষম্য বাড়বে। কর কমানোর সুফল শুধু বিত্তবানরাই পাবে। তবে সার্বিক অর্থনীতিতে এতসব ছাড়ের সুফল পেতে হলে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। স্বল্প সময়ে এর ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না বলে ধারণা করা যায়।

সুপারিশ :

. কর ভ্যাট ছাড়ের ফলে রাজস্ব সংগ্রহে প্রাথমিক পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সেজন্য রাজস্ব প্রশাসনের জনবল বৃদ্ধি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যাতে কর জাল বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহে গতিসঞ্চার করা যায়।

.            কর কমানোর ফলে সব ব্যবসায়ী উৎপাদনকারীই রাতারাতি সঠিক কর প্রদানে মনোযোগী হয়ে যাবেন, এমন প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। কর ফাঁকি রোধে এনবিআরের কর্মকর্তাদের কৌশলী হতে হবে। এক্ষেত্রে কর আহরণ ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন মেশিনের ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। জেলা থানা পর্যায় পর্যন্ত কর অফিস সম্প্রসারিত করে তদারকি জোরদার করতে হবে। এনবিআরের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ।

.            বাংলাদেশের কর কাঠামোই বিশ্বে সবচেয়ে ব্যবসা বৈরী, এমন চিন্তা করার কোনো ভিত্তি নেই। উন্নত দেশের ভ্যাট কর কাঠামোতে কর ফাঁকির সুযোগ খুবই সীমিত। স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা বিদ্যমান। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে ভ্যাট হার ১৫-২৪ শতাংশ। জনগণ যে ভ্যাট প্রদান করে তা ব্যবসায়ী বা অসৎ কর কর্মকর্তাদের আত্মসাৎ করার সুযোগ নেই। আমাদের দেশেও ডিজিটাল হিসাবরক্ষণের মাধ্যমে সে ব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। দেশে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির অনুষঙ্গ হিসেবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে অবশ্যই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

. নতুন প্রণীত কাস্টম আইন কয়েক বছর ধরে সংসদে পাসের অপেক্ষায় আছে। এটি অর্থবছরের ৩০ জুনের মধ্যেই পাস করা জরুরি, তা না হলে আবারো তামাদি হয়ে যাবে। নতুন কর আইন প্রণয়নের বিলম্ব প্রত্যাশিত নয়। এসব আইনি সংস্কার ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ এবং রাজস্ব সংগ্রহে স্বচ্ছতা গতিসঞ্চারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

.            করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগ বিপর্যয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের খরচ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বা নিয়মে নির্বাহ করা যাবে না। যেখানে যখন প্রয়োজন নতুন বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহে যেন অর্থ ঘাটতি না হয়, কর্মহীন দরিদ্র লোক যাতে অনাহারে কষ্ট ভোগ কিংবা বিপর্যয়ের মুখোমুখি না হয় সেজন্য যখন প্রয়োজন তখনই অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ কিংবা নগদ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক, ক্ষুদ্র, কুটির মাঝারি শিল্পে নিয়োজিত ব্যক্তি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা উৎপাদন সচল করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জীবন জীবিকার জন্য বাজেট সত্যকে অর্থবহ করে বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান; বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন