অভিমত

কৃষির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তাবিত বাজেট

ড. মো. সাইদুর রহমান

গত জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ৫০তম জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মৃত্যুঞ্জয়ী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে অতিমারী করোনায় জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ প্রতিপাদ্য ধরে সরকারের ২০২১-২২ অর্থবছরে লাখ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (,৩৮,৯৮৩ কোটি টাকার) চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি এবং গত বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের (,৬৮,০০০ কোটি টাকা) চেয়ে দশমিক শতাংশ বেশি।

করোনা পরিস্থিতিতে কৃষি খাতে ৩১ হাজার ৯১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (২৯,৭২৫ কোটি টাকার) চেয়ে দশমিক শতাংশ বেশি। তবে তা ওই বছরের প্রস্তাবিত ২৯ হাজার ৯৮১ কোটি টাকার চেয়ে মাত্র দশমিক শতাংশ বেশি। আশা করা যায়, করোনা মোকাবেলায় বাজেটে শস্য, মত্স্য প্রাণিসম্পদ খাতে অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে শস্য প্রাণিজ উৎস থেকে পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সরকার উদ্যোগী হবে। তাছাড়া মত্স্য প্রাণিসম্পদ খাতে গ্রামীণ কর্মসংস্থান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক দিক।

বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার কৃষিকে আগাগোড়াই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কভিড-১৯ মোকাবেলায় ২৩টি প্যাকেজে মোট লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে, যার মধ্যে হাজার ৭০৮ কোটি টাকা শতাংশ সুদে শুধু কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। সরকার অর্থবছর সব খাতে মোট ৩৫ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করেছে, যা গত বছরের সংশোধিত বাজেটের ৩৬ হাজার ৫০১ কোটি টাকার চেয়ে কিছুটা (. শতাংশ) কম। ওই ভর্তুকির ২৮ দশমিক শতাংশই প্রদান করা হয়েছে কৃষি খাতে, যার পরিমাণ ১০ হাজার ৯৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের সংশোধিত বরাদ্দ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকার চেয়ে ১৭ দশমিক শতাংশ বেশি। বাড়তি বরাদ্দের মধ্য দিয়ে সরকার কৃষিকে গুরুত্ব সহকারে দেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষি খাতের উন্নয়ন বরাদ্দ যেন যথাযথভাবে ব্যয় হয় এবং প্রয়োজনে আরো নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করে বরাদ্দ বাড়ানো হলে করোনায় মানুষের দুর্ভোগ কমবে।

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ২৯ দশমিক ৪৯ লাখ টন  চাল-গম ক্রয় করা হবে, যা আগের বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক শতাংশ কম। ওই চাল-গম ক্রয় করা হবে ১৩ হাজার ৭০ কোটি টাকার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দ ব্যয়ের চেয়ে ১৪ কোটি টাকা কম। মোট চাল-গম ক্রয়ে ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে হাজার ১২৮ কোটি টাকার চাল গম ক্রয় করা হবে এবং আমদানীকৃত চাল গম ক্রয়ে হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের সংরক্ষণ বৃদ্ধি এবং আমদানিতে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে কোনো ধরনের খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে না হয়।

কৃষি খাতে সার্বিক বরাদ্দ বাড়েনি, বাড়েনি উন্নয়ন খাতেও কৃষির বরাদ্দ, তথাপিও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। করোনায় প্রমাণিত হয়েছে যে কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে মজবুত জায়গা। এটা প্রমাণিত যে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় যদি কৃষিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে তাহলে কৃষি তার জোগান প্রাক্কলিত হারেই দিয়ে যায়। বহুল জনসংখ্যার দেশকে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে তেমন কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় না। আর সে কারণে স্বাভাবিকভাবে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই কৃষিতে একটু বেশি বরাদ্দ আশা করেন। তবে করোনা মোকাবেলা করার জন্য প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবেই আরেকটু বেশি ছিল।

বাজেটে শস্য খাতে আমদানি, রফতানি সরবরাহের বিপর্যস্ত হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে বোরো ধান কর্তনে কম্বাইন হারভেস্টার প্রদানের মাধ্যমে অনিশ্চয়তা দূর করা হয়েছে। গম আমদানির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা এবং সবজি সরবরাহ ঠিক রাখতে সবজি বাজারজাতে উৎসাহ দিতে সরকার ব্যবস্থা নেবে। কৃষি খাতে ভর্তুকি, সার, বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণে প্রণোদনা সহায়তা কার্ড, কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা এবং স্বল্প সুদে সহজ শর্তে বিশেষ কৃষিঋণ সুবিধা প্রদান অব্যাহত রাখা হবে। দেশে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা কোটি লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৮ জন, যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বেশি। 

গত বছরের বাজেটে ১০৯টি জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শস্য বহুমুখীকরণ, ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো, খামার যান্ত্রিকীকরণ জোরদারকরণ এবং বাস্তবায়নের জন্য আগামী অর্থবছর হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ, কৃষি পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে হাজার ৭০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা, রাসায়নিক সারসহ অন্য সব ক্ষেত্রে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার ঘোষণা সরকারের অত্যন্ত সতর্ক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জায়গা চাষের আওতায় আনা এবং প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২টি করে পুষ্টি বাগান সৃজন করা হয়েছে এবং বছর প্রতিটি ইউনিয়নে আরো ১০০টি করে পারিবারিক পুষ্টি বাগান করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা অত্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ।

বাজেটে দেশে মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মিঠা পানির মাছের নতুন জাত উদ্ভাবন গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, সামুদ্রিক মত্স্য সম্পদ আহরণে নতুন প্রযুক্তি উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রস্তাবিত সামুদ্রিক আইন, ২০২০ অনুমোদনের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য জাহাজ সংগ্রহের প্রকল্প গ্রহণ, ব্লু ইকোনমির সুফল পাওয়ার জন্য গভীর সমুদ্রে জেলেদের ব্যবহূত ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালিং উপকরণে আমদানি শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব এবং বেসরকারি খাতেও গভীর সমুদ্র থেকে মাছ সংগ্রহের পৃষ্ঠপোষকতার ঘোষণা সামুদ্রিক মাছ আহরণের অপার সম্ভাবনাকে আরো বেগবান করবে। আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে মত্স্য খাদ্যের দাম কমবে বলে আশা করা যায়।

প্রাণিসম্পদ খাতে বিশেষ করে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি পালনে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। ডিম দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে উৎপাদন গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, ডিম-দুধ বাজারজাতে সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি, নতুন জাত প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণায় এবং প্রশিক্ষণে অনুদান বৃদ্ধির পদক্ষেপ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদ খাতে নিঃসন্দেহে গতিসঞ্চার করবে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত লাখ হাজার ৪০২ জন ডেইরি পোলট্রি খামারিকে এবং ৭৮ হাজার ৭৪ জন মত্স্য খামারিকে নগদ, বিকাশ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৫৬৮ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে, যার কারণে তারা নিজ নিজ ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।

গত অর্থবছরে কৃষি কৃষিসংশ্লিষ্ট উৎপাদন এবং সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কুটির শিল্প ইত্যাদি খাতে দরিদ্র কৃষক, বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক এবং প্রশিক্ষিত তরুণ যুবাদের গ্রামীণ এলাকার ব্যবসা আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করোনা পরিস্থিতিতে সবাইকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। পোলট্রি খাতের প্রতিরক্ষণে প্রক্রিয়াজাত মুরগির অংশবিশেষসহ সংশ্লিষ্ট সব আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব অব্যাহত রাখা হয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে অবশ্যই উৎসাহিত করবে।

সব শেষে, কৃষির বিভিন্ন সেক্টর যেমন শস্য, মত্স্য গবাদিপশু বীমা চালু করার উদ্যোগ কৃষক, জেলে, খামারিসহ সংশ্লিষ্ট সেক্টরে বিনিয়োগকারীদের বিশেষভাবে উজ্জীবিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উল্লিখিত বিশ্লেষণ থেকে উপসংহারে আসা যায় যে সরকারের বাজেটে ইতিবাচক প্রস্তাবনার যথাযথ বাস্তবায়ন হলে দেশের কৃষি, কৃষক এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবে। তবে নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা মোকাবেলার জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল, যা প্রচারমাধ্যম বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের আলোচনায় উঠে এসেছে। সেগুলো হলো: কৃষিদ্রব্যের সর্বনিম্ন মূল্য আগাম ঘোষণা, উপজেলা পর্যায়ে কৃষিবাজার স্থাপন করে বড় বড় শহরের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সংযোগ বৃদ্ধি, ধান-চাল ক্রয় সংগ্রহের সক্ষমতা বাড়ানো এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ক্রয়কার্য সংরক্ষণ সম্পন্ন করা, কৃষিদ্রব্যের চাহিদা জোগানের সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে ঋণ প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা কৃষক উদ্দীপন ফান্ড নামে কৃষকদের আবাদি জমির বিপরীতে নগদ অর্থ বরাদ্দ রাখা এবং কৃষি গবেষণায় (বাজার ব্যবস্থাপনাসহ) অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলে কভিড-১৯-এর বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া কৃষির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী কৃষি কমিশন থাকা প্রয়োজন, যারা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে এবং বিভিন্ন দেশের কৃষিপণ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রক্ষেপণ সরকারের নীতি প্রণয়নে যথাযথ পরামর্শ প্রদান করতে পারবে।

সুপারিশগুলো সরকারের চূড়ান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হবে প্রত্যাশা রেখে আসুন আমরা সবাই মিলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করি এবং প্রাণঘাতী করোনার রাহুগ্রাস থেকে দেশের অর্থনীতি মানুষকে রক্ষা করি।

 

. মো. সাইদুর রহমান: অধ্যাপক, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ

পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন