করোনার মধ্যেও ঊর্ধ্বমুখী সড়ক দুর্ঘটনা

সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুর্বলতারই প্রতিফলন

চলছে করোনা মহামারী। মহামারীর মধ্যে প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান মিয়ানমারে সড়ক দুর্ঘটনা কমার খবর মিলছে। উল্লিখিত দেশ তিনটিতে দুর্ঘটনা যথাক্রমে ২০, ১৩ ১৯ শতাংশ কমেছে। অথচ উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০- দেশে অর্ধশত দুর্ঘটনা বেশি হয়েছে। আরো শঙ্কাজনক তথ্য হলো, ২০১৪ থেকে ২০২০ সাত বছরে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির হার ১০৭ শতাংশ। বড় উল্লম্ফন বৈকি। এরই মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা এক গুরুতর জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। দিন দিন এর ভয়াবহতা বাড়ছে। নিয়তই প্রাণ ঝরছে সড়কে। এর রাশ টানা জরুরি।

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গত বছর দীর্ঘ সময় যানবাহন চলাচল সীমিত ছিল। সেই বিবেচনায় সড়ক দুর্ঘটনা কমার কথা। কিন্তু তথ্যে বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে। এর পেছনে একটি নয়, একাধিক কারণ রয়েছে। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ছোট ছোট গাড়ি সড়ক-মহাসড়কে ঠিকই চলাচল করেছে। এমনকি মোটরসাইকেলে চেপেও অনেকে দূরের পথ পাড়ি দিয়েছে। একে তো অদক্ষ, তার ওপর ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়েছেন চালকরা। বিধিনিষেধের কারণে তাদের মধ্যে অনেক সময় মনস্তাত্ত্বিক চাপও কাজ করেছে। উপরন্তু, ছোট গাড়িগুলো হালকা তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বোপরি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ওই সময়ে ট্রাফিক নজরদারি কম ছিল। নতুন সড়ক আইন করা হলেও তার প্রয়োগ ঘটানো যায়নি। সব মিলিয়ে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। অথচ একই সময়ে ভারতে নতুন মোটরযান আইনের বাস্তবায়ন, আইনে জরিমানা শাস্তি বাড়ানো, যানবাহন নজরদারি প্রক্রিয়ার আধুনিকায়নের ফলে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে। পাকিস্তানে কমেছে লকডাউন যথাযথভাবে কার্যকর করা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থার কড়াকড়ির কারণে। একইভাবে মিয়ানমারেও করোনাসংক্রান্ত বিধিনিষেধ সেনা শাসন-পরবর্তী রাজনৈতিক সংঘাতে যানবাহন চলাচল সীমিত করার কারণে দুর্ঘটনা কমেছে। উন্নত দেশ দূরে থাক, প্রতিবেশী দেশগুলোর বাস্তবতা আমলে নিলেও আমাদের সড়ক নিরাপত্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ! এটা হতাশাজনক।

শুধু করোনাকালীন নয়, আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটা সাংবৎসরিক সবসময়ের সমস্যা। সময়ান্তরে এটি আরো প্রকট হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে চালকদের বেপরোয়া আচরণ অনিয়ন্ত্রিত গতি তো রয়েছেই। আরো আছে অদক্ষ ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনগণ তথা পথচারীদের অসচেতনতা, অপরিকল্পিত গতিরোধক, সড়ক নির্মাণে ত্রুটির মতো বিষয়গুলো। এসব বিষয় সংশ্লিষ্টদের অজানা নয়। এগুলো সমাধানে বিশেষজ্ঞরা নানা সময়ে বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ফলে সড়কে দুর্ঘটনা মৃত্যুর মিছিল থামছে না। আর শৈথিল্য নয়; সামগ্রিকভাবে সড়ক নিরাপত্তার উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্রিয়তা এখন সময়ের দাবি।

সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের একটি বড় উপায় ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোয় আজকাল আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো পশ্চিমা উন্নত দেশের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, জাপান দক্ষিণ কোরিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোও প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এমনকি ভারতও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তারা প্রযুক্তির সন্নিবেশে নানা অভিনবমূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। যেমন দেশটি গতিরোধকে দুর্ঘটনা কমাতে স্মার্টফোনভিত্তিক স্পিড ব্রেকার আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (এসডব্লিউএএস) প্রবর্তন করেছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে রকম অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগ ভারতে চলমান কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সনাতনী কায়দায় চলছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, যা অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাগুলো আমলে নিয়ে এক্ষেত্রে দ্রুতই অগ্রগতি দরকার।

নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনপূর্বক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতিসংঘ গত দশককে সড়ক নিরাপত্তা দশক হিসেবে ঘোষণা করেছিল। সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে সদস্য দেশগুলো একমতও হয়েছিল। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে অঙ্গীকারাবদ্ধ। অথচ দুঃখজনকভাবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে বৈ কমছে না। দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়ক নিরাপত্তাকে দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে। এটি উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বাগ্রে একটি শক্তিশালী জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করতে হবে। অনেক দেশেই এটি রয়েছে। এর কাজ হবে দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান দেয়া এবং নিয়োজিত সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ গড়ে তুলতে হবে। ওই ডাটাবেজে কোথায়, কখন দুর্ঘটনা ঘটেছে, কারা দায়ী, দুর্ঘটনাস্থলের পরিবেশগত অবস্থা কেমন ছিল, কীভাবে দুই বা একাধিক গাড়ির সংঘর্ষ ঘটল প্রভৃতি তথ্য প্রতিদিন সংরক্ষিত থাকবে। এতে দুর্ঘটনার প্রবণতাগুলো বুঝতে তদনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সহায়ক হবে। সড়কের নির্মাণ ত্রুটির কারণেও এখানে দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই সড়কের বিজ্ঞানসম্মত-নিরাপদ পরিকল্পনা ডিজাইন তৈরি করাটাও জরুরি। সমরূপভাবে কিছু বিপজ্জনক ভাঙাচোরা জায়গা আছে, যেখানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। সেগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। শিশুদের শেখাতে পাঠ্যক্রমে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়গুলো সংযোজন করতে হবে। সমাজের জন্য এর সুফল হবে জীবনব্যাপী। বাড়াতে হবে চালকদের প্রশিক্ষণ টেস্টিং সক্ষমতা। আইনি কড়াকড়িও দরকার। নতুন সড়ক আইনে জরিমানা শাস্তি উভয়ই বাড়ানো হয়েছিল। পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের চাপে সেটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা দুর্ঘটনা বাড়ায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সুতরাং এটিও পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। নিয়মিত যানবাহনের নিরাপত্তা মান পরীক্ষা যথাযথ মান বজায় রাখার উদ্যোগ চালু রাখতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের নজরদারি আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ট্রাফিক শৃঙ্খলা আসে। জনসাধারণকে সচেতন করতে বাড়াতে হবে ট্রাফিক-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণা। একই সঙ্গে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা বাড়ানোও প্রয়োজন। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের জন্য জরুরি চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করা চাই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই দুর্ঘটনায় আহতদের মৃত্যু ঘটে। তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে সংগঠিত অ্যাম্বুলেন্স সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আলাদা লেন করা যেতে পারে। দুর্ঘটনার খবর মুহূর্তেই পুলিশকে জানাতে একটি টোলমুক্ত একক নম্বর চালু করা যেতে পারে। বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হবে বৈকি।

কেবল মানবিক নয়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দুর্ঘটনা রোধ করা জরুরি। গবেষণায় উঠে এসেছে কর্মক্ষম মানুষই বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতির শিকার। সেদিক থেকে কর্মক্ষম একজন মানুষের মৃত্যু একই সঙ্গে কোনো কোনো পরিবারের জন্য আয় হারানো এবং জাতীয় আয়ে নেতিবাচক প্রভাবের কারণও বটে। এক হিসাব বলছে, ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনা হ্রাসের টার্গেট পরিপূরণ থেকে ২২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। সুতরাং বিষয়টি আমলে নিয়ে সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়নে সরকার দ্রুত সচেষ্ট হবে, এটাই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন