শিশুরা পবিত্রতার প্রতীক। শিশু বলতেই সারল্য, চাঞ্চল্য, নির্মল হাসি চোখে ভেসে আসে। খেলাধুলা, হৈ-হুল্লোড় আর ছোটাছুটিতে মাতিয়ে রাখে চারপাশ। সবার কত শত আশা-আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু পরিবারের এ সদস্য। অবুঝ হলেও আদর, মমতা, ভালোবাসা বুঝতে দেরি হয় না। মিথ্যে বিয়ে বিয়ে খেলা, কাদা মাটিতে পিচ্ছিল খাওয়া, দৌড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া, গাছের ডাল কেটে বন্দুক বানিয়ে চোর-পুলিশ খেলায় তার আনন্দ। সদ্য শেখা অ, আ এঁকে দিতে চায় মাটি, দেয়াল সবখানে। পরিবার, পারিপার্শ্বিকতায় তৈরি হতে থাকে জীবনাচরণ।
শিশুরা খুব কৌতূহলী। আকাশের ওপারে কী আছে, পাখিদের বাসা কোথায় ইত্যাদি প্রশ্নে জেনে নিতে চায় পৃথিবীকে। কোনো পছন্দের কার্টুন বা গল্পের চরিত্রে আবিষ্কার করতে চায় নিজেকে। আপন করে নিতে চায় কোনো জীবনাদর্শ। তবে এত দিনেও শিশুদের জন্য আমরা হয়তো পারিনি নিজ ঐতিহ্যের কোনো সুপারহিরোকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। যে চরিত্রকে শিশুরা চর্চা করবে নিজ কল্পনাজগতে। হতে চাইবে তার মতন। অথচ বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে রয়েছে অনেক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। কৃষকের ঘাম, শহীদের রক্ত, যুদ্ধ বিজয়ীদের পদচিহ্ন নিয়ে আমাদের আছে অতুলনীয় সমৃদ্ধ ইতিহাস। পলাশীর প্রান্তর বা নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা থেকে চাইলেই বেরিয়ে আসে কত বীরত্ব কথা। আকর্ষণীয় শিশুতোষ গল্পে বা মজার কার্টুনে শিশুদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কিছু হয়তো না। অন্তত ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’-এর বীরত্ব তুলনায় ঐতিহাসিক কিছু জানত।
শিশু-কিশোররা বিনোদনপ্রিয়। আনন্দঘন সময় পেতে চায়। হোক বাসায় কেরাম বা লুডু খেলা, কোথাও ঘুরতে যাওয়া খুব উপভোগ করে। সভ্যতার দুর্নিবার যাত্রায় আমাদের জীবন ব্যস্ততাময়। ইচ্ছে হলেও ব্যস্ত জীবনে মা-বাবারা অনেকাংশে সময় দিতে পারেন না। তখন সন্তানদের প্রতি সচেতন দৃষ্টি দেয়া কষ্টসাধ্য হয়। আবার ধনী মা-বাবা সময় দিতে না পারার শূন্যতা পূরণে ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকেন। তাই প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে শিশু-কিশোরদের হাতে চলে আসে ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি। শুরু হয় ভার্চুয়াল জীবন।
অনলাইন দুনিয়া বিশেষ মজার। এখানে থাকে উদার স্বাধীনতা। ধরা-ছোঁয়া না গেলেও পাওয়া যায় সব। ফেসবুক, গেমস সিরিজসহ অন্যান্য স্ট্রিমিং করে সহজেই পার করা যায় সময়। যখনই ঘড়ির কাঁটা আস্তে ঘুরে, এর সহজ সমাধান এখন নেট ব্রাউজিং বা গেমিং। হোক বাসায়, যানবাহন বা কর্মস্থলে। সুখ-দুঃখ, সকাল-বিকাল সার্বক্ষণিক যেন এক প্রিয় সঙ্গী। অভিভাবকরা ডিভাইসগুলো পড়াশোনার বাইরের সময় ব্যবহারের জন্য দিলেও ক্রমে তা সন্তানদের পড়াশোনাকেই বাইরে রেখে দেয়। অবসর সময়টুকু দখল করে নেয় প্রযুক্তিসৃষ্ট বিনোদন। ধীরে ধীরে তৈরি করে নিচ্ছে নিজেদের বাস্তবতামুক্ত অনলাইন বিচ্ছিন্ন দুনিয়ায়। দিন শেষে পরিবারের সবাই কয়েক ঘণ্টা একসঙ্গে হলেও প্রত্যেকের থাকে স্ব-স্ব ডিভাইস সঙ্গীর দিকে মনোযোগ। পরিবারের সদস্যদের মিথস্ক্রিয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে স্ক্রিন বা মনিটর। গতি বাড়ছে ইন্টারনেটের, সংযোগ কমছে নিজেদের।
সম্প্রতি পাবজি ও ফ্রি ফায়ার গেমস দুটি নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান আসক্তি বন্ধে গেমস দুটি নিষিদ্ধের পক্ষে দাবি উঠে এসেছে। কিন্তু নিষিদ্ধ করা কি স্থায়ী সমাধান, তা নিয়ে সংশয় থাকে। মা-বাবারা কতটুকু জানেন সন্তান ফোন বা অন্যান্য ডিভাইস কি উদ্দেশ্যে বা কত সময় ব্যবহার করছে? বাস্তব জীবনে সন্তানের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দিতে বলা হয় তারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে। এখন অনলাইন হলো জীবনের নতুন মাত্রা। তাই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সেই খেয়াল রাখতে হবে তার অনলাইন জীবনেও। কিছু অ্যাপস নিষিদ্ধ করে দেখা যাবে কিছুদিন পরেই হয়তো সমজাতীয় অন্য কোনো গেমস এসে এর জায়গা দখল করবে।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা সক্রিয় ভূমিকা রাখে। শহর, শহরতলি কিবা মফস্বলেও হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। একই সঙ্গে হারাচ্ছে স্থানীয়ভাবে আয়োজিত বিভিন্ন টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতা। দলবেঁধে খেলাধুলায় যে একতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধের শিক্ষা লাভ করা যায়, তা বলা বাহুল্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জয়-পরাজয় মেনে নেয়ার যে চারিত্রিক-মানসিক দৃঢ়তা, তা তৈরি হচ্ছে না। সুস্থ বিনোদনের মূলধারা থেকে বঞ্চিত হয়ে দীর্ঘ সময় থাকছে অনলাইন দুনিয়ায়। সংগতভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে শিশু-কিশোর বা তরুণদের।
জীবনে টিনএজ বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ বয়সে কিশোর-কিশোরীদের মাঝে দেখা দেয় নানা পরিবর্তন। হতে চায় আত্মনির্ভর এবং পেতে চায় স্বাধীনতা। নিজের পোশাক বা ফ্যাশন নিয়ে আত্মসচেতনতা থাকে এ সময়ে। মনোযোগ পাওয়ার এক সুপ্ত ইচ্ছে গড়ে ওঠে ভেতরে। হালের ধারায় অনুসরণ করে থাকে চলমান সব চর্চা। এ প্রবণতাকে পুঁজি ও উত্সাহিত করে টিকটক, লাইকি বা সমজাতীয় প্লাটফর্ম। তাই গান-নাচ নিয়ে একে একে পোস্ট হতে থাকে ভিডিও। তৈরি হতে থাকে ফলোয়ার বা অনুসারী। তাই কিশোর-কিশোরীদের মাঝে এগুলো এত জনপ্রিয়। শুধু কি তাই! এখানে নিজের উচ্চতা প্রমাণে ফ্যান-ফলোয়ারের (অনুসারী) সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। তাই এসব নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা, কখনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তৈরি হয় গ্রুপিং, গ্রুপিং থেকে গ্যাং বা কিশোর গ্যাং। বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে হানাহানি সংঘটিত হয়।
অধিকন্তু, যাদের ফ্যান-ফলোয়ার বেশি, তাদের সঙ্গে ভিডিও করার আগ্রহ তৈরি হয় সবার মাঝে। কেননা এতে রাতারাতি নিজেকে প্রচার করা যায়। এ লোভকে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবহার করেন ফাঁদ হিসেবে। যে রঙিন ফাঁদে পা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে অনেক তরুণী বা কিশোরী। ইদানীংকালে নারী পাচারের মতো ঘটনাও সামনে আসছে। এর পেছনে থাকে স্বল্প সময়ে খ্যাতি ও অর্থলিপ্সা। যে বয়সে জানার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশ, চর্চা করার কথা বিভিন্ন সৃজনশীল অভ্যাস, ঠিক তখন আগামী প্রজন্ম ঠিক কোন পথ বেছে নিচ্ছে নিজেদের জন্য, তা বোধগম্য হয় না। টিকটক, লাইকি ব্যবহারকারী অনেকেই দাবি করেন, এর মাধ্যমে তাদের অভিনয় মেধা বিকশিত হবে। সেজন্যই নাকি অনেক প্রতিষ্ঠিত অভিনয় শিল্পী এখানে ভিডিও করে থাকে। তাহলে তারা কি দাবি করতে চান মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠিতদের অভিনয় গুরু এসব অ্যাপস?
যৌথ পরিবার ভেঙে যখন একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখন সংশয় প্রকাশ করতেন সমাজবিদরা। পরিবার প্রথা কি ভেঙে যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনে কিছুটা দুর্বল হয়েছে পারিবারিক সচেতনতা। সভ্যতা উত্কর্ষের এ পর্যায়েও কোনো প্রযুক্তি অভিভাবকের বিকল্প হতে পারেনি।
আসিফ আহমেদ: পিআরও, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়