দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের ইহুদিরা বসবাস করত রাজশাহীতে

সাইফ বাপ্পী ও আল ফাতাহ মামুন

চারশ বছরেরও পুরনো নগরী ঢাকা এক সময় ছিল উপমহাদেশের বৃহৎ এক বাণিজ্য কেন্দ্র। ঢাকা তথা বাংলার ঐশ্বর্যের টানে এখানে ব্যবসা করতে এসেছেন অনেক বিদেশী। আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও করেছেন কেউ কেউ। ঢাকায় এখন আর সেসব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা যায় না। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সে বণিক সম্প্রদায়গুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক পর্ব-

এক সময়ে পূর্ববঙ্গেও বসতি গেড়েছিল ইহুদি বণিকরা। ভূখণ্ডে তারা এসেছিল শুধু ব্যবসার তাগিদেই। সংখ্যায় তারা ছিল অনেক কম। তার পরও বস্ত্র রত্নের ব্যবসার মাধ্যমে সমসাময়িককালের ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে নিয়েছিল তারা। কালের পরিক্রমায় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে তাদের। তবে এখানকার শেকড়কে ভুলতে পারেনি তাদের অনেকেই।

ইহুদিরা দেশে এসেছিল শুধু ব্যবসার তাগিদেই। দেশভাগের আগ পর্যন্ত তাদের ব্যবসা ছিল প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক। কেউ কেউ ব্যবসা করেছে রাজশাহী অঞ্চলেও। তবে দেশভাগের পর এদেশী ইহুদিরা প্রধানত রাজশাহীতেই বসবাস করতে থাকে। ওই অঞ্চলের ইহুদিরা ছিলেন প্রধানত বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক। যদিও তারা নিজেদের পরিচয় দিতেন বারেন্দ্র বা বরেন্দ্র অঞ্চলের ইহুদি হিসেবে।

ষাটের দশকে তাদের বড় একটি অংশ দেশ ছেড়ে চলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেয় এখানকার জনগণ। ওই সময়ে পূর্ববঙ্গের পরিবেশ এখানকার ইহুদিদের জন্য প্রতিকূল হয়ে ওঠে। ফলে ইহুদিরাও ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। চলে গেলেও এখানকার স্মৃতি তাদের অনেককেই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আজীবন।

এমনই একজন ছিলেন মর্ডিকাই কোহেন (মর্ডি কোহেন) তার পরিবার রাজশাহী অঞ্চলে ব্যবসা করেছে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে। মা ছিলেন কলকাতার মেয়ে। সেখানেই জন্ম হয়েছিল মর্ডি কোহেনের। তবে পিতার ব্যবসার সুবাদে তার বেড়ে ওঠা রাজশাহীতেই। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক সংবাদ পাঠক। ঢাকা ছাড়ার আগে এখানকার কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন মর্ডি কোহেন। খান আতাউর রহমান পরিচালিত সিরাজউদ্দৌলা সিনেমায় ফরাসি সেনাপতি সাঁফ্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পূর্ববঙ্গে ইহুদিবিরোধী মনোভাব বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে সপরিবার ভারতে চলে যান মর্ডি কোহেন।

২০১৮ সালে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান মর্ডি কোহেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ এসেছিলেন ২০১৪ সালে। বিটিভির সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে শুধু বারেন্দ্র ইহুদি পরিচয় ত্যাগ করেননি মর্ডি কোহেন। বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে রাজশাহীতে পদ্মার পারে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো বা সেখানকার বন্ধুদের কথাই বলেছেন বারবার। 

দেশের ইতিহাসের মহত্তম অর্জন স্বাধীনতার সঙ্গে মর্ডি কোহেনের পরিবারের যোগসূত্র রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ঢাকার পতন পাকিস্তানিদের দ্রুত আত্মসমর্পণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (তত্কালীন) জেএফআর জ্যাকব। কলকাতার বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্য জেএফআর জ্যাকব ছিলেন মর্ডি কোহেনের মামা।

ইহুদিদের মধ্যে বাগদাদিরাই প্রথম পূর্ববঙ্গে এসেছিল। এখানে তাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল শ্যালোম কোহেনের (১৭৮২-১৮৩৬) হাতে। পশ্চিমবঙ্গের ইহুদি বণিক সমাজেরও তিনিই আদিকর্তা। শ্যালোম কোহেন প্রথমে এসেছিলেন কলকাতায়। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সুরাট থেকে ১৭৯৮ সালে স্থানান্তরিত হন তিনি। ওই সময় তার নজর পড়ে ঢাকার মসলিন রেশমি বস্ত্র শিল্পের দিকে। ঢাকায় বস্ত্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য কলকাতা থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পাঠিয়েছিলেন তিনি।

১৮১৭ সালের দিকে মোজেস ডুয়েক নামের আরেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বড় মেয়ে লুনাহর বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিয়ের পর নববিবাহিত দম্পতি ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। এখানে তারা ছিলেন পাঁচ বছর। কথিত রয়েছে, সময় তারা এখানে উপাসনার জন্য একটি প্রেয়ার হলও স্থাপন করেন। তবে এখন পর্যন্ত ওই প্রেয়ার হলের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মোজেস ডুয়েকের ঢাকার ব্যবসার অংশীদার ছিলেন আলেপ্পোর অধিবাসী এক -ইহুদি ব্যক্তি। ১৮২২ সালের দিকে ডুয়েক পরিবার কলকাতায় ফিরে যায়। ফিরে গেলেও ঢাকার ব্যবসা চালু রাখে পরিবারটি।

হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমের অধ্যাপক . শালভা ওয়েইল জানাচ্ছেন, ওই সময়ে ইহুদিদের সিংহভাগই বসবাস করত কলকাতায়। ঢাকা ছিল তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র। কলকাতা থেকেই এখানে বস্ত্র, মুক্তা আফিমের মতো পণ্যের কারবার চালিয়েছে তারা। পরে কলকাতা থেকে ইহুদি বণিকদের গুটিকয়েক পরিবার পূর্ববঙ্গে এসে বসবাস শুরু করে। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে ইহুদির সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে বসবাসরত ইহুদির সংখ্যা ছিল মোটে ১৩৫।

তাদের মধ্যে বাগদাদিরা ছাড়াও বেনে ইসরায়েল সম্প্রদায়ের ইহুদিরাও ছিল। বিভিন্ন উৎসে পাওয়া তথ্য বলছে, ষাটের দশকেও বেনে ইসরায়েল সম্প্রদায়ভুক্ত কয়েকটি পরিবার ঢাকায় বসবাস করত।

প্রয়াত ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন তারিক আলি বাল্টিমোর পোস্ট এক্সামিনারকে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশে দুটি ইহুদি পরিবার ছিল। এর মধ্যে একটি ১৯৭৩ আরেকটি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।

যদিও . শালভা ওয়েইলের বর্ণনায় এর পরেও বাংলাদেশে ইহুদি ব্যবসায়ীদের অবস্থানের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানাচ্ছেন, কানাডার অন্টারিওতে বসবাসকারী জোসেফ এডওয়ার্ড নামে এক বাংলাদেশী ইহুদির তথ্য উঠে এসেছে। জোসেফ এডওয়ার্ড নিজেই তাকে তার পরিবারের ইতিহাস লিখে পাঠিয়েছেন।

জোসেফ এডওয়ার্ডের পরিবার ছিল চট্টগ্রামের বাসিন্দা। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন তিনি। তার পিতা রাহামিম ডেভিড বারুক চাচা এজরা বারুকের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। পরে তারা সেখান থেকে পূর্ববঙ্গে চলে এসেছিলেন। একই সঙ্গে নিজেদের পদবি হিসেবে এডওয়ার্ড ব্যবহার করতে শুরু করেন। ডেভিড বারুক হয়ে যান ডেভিড এডওয়ার্ড। পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত এক ক্যাথলিক খ্রিস্টানকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এজরা বারুক নাম পাল্টে হন এডি এডওয়ার্ড। পার্বত্য চট্টগ্রামের এক চাকমা রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। জোসেফের পিতা রাহামিম ডেভিড এডওয়ার্ড বিনিয়োগ করেছিলেন জাহাজ শিল্পে।

তাদের পরিবারও ছিল বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত। তার এক পূর্বপুরুষ এজরা বারুক বা হাচেম রিউবেন ছিলেন বাগদাদের নামকরা এক র্যাবাই পরিবারের সন্তান। ১৯০০ সালে কলকাতায় তার মৃত্যু ঘটে। বর্তমানে জোসেফ এডওয়ার্ডের স্বজনরা ইসরায়েলের আরাদ বিরশেবা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য কানাডায় বসবাস করছেন।

শুধু স্বাধীনতা নয়, দেশের আরেক মহত্তম অর্জন গণতন্ত্রের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এক ইহুদির নাম। দেশে গণতন্ত্রের পীঠস্থান জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কান ছিলেন পোলিশ ইহুদি।

পর্ব-১ : কলকাতা-করাচিতে থাকলেও ঢাকায় নেই আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা

পর্ব-২ : র‍্যালি ব্রাদার্সকে আজও স্মরণ করে নারায়ণগঞ্জ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন