লিচুর জন্য বিখ্যাত দিনাজপুর জেলা।
জ্যৈষ্ঠ মাসে দিনাজপুর জেলার ফলের বাজার ভরপুর থাকে লিচু আর আমে।
কিন্তু করোনাকালে দিনাজপুর জেলা লিচু ও আম বাগানিদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পণ্য পরিবহনের সমস্যা।
এ সমস্যাই যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে অনলাইনে ফল বিক্রেতাদের কাছে।
দিনাজপুরের লিচু ও আমের সমাদর দেশজুড়ে।
রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জেলার ফলপ্রেমী মানুষদের কাছে এ লিচু ও আম পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন প্লাটফর্ম, যা করোনা মহামারীকালে আরো জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
অন্যান্য পেশার পাশাপাশি অনেকেই বাড়তি আয়ের জন্য অনলাইনে বিক্রি করছিল মৌসুমি ফল।
বিশেষ করে ফেসবুক পেজ ও নিজ প্রোফাইলে লিচু ও আমের ছবি দিয়ে অনেক শিক্ষিত বেকার, তরুণ-তরুণীরা যুক্ত হচ্ছেন মৌসুমি ফল ব্যবসায়।
অনেকেই নিজের বাগান থেকে এসব ফল অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তে।
এসব ফল বিক্রির সঙ্গে যেসব তরুণ-তরুণী যুক্ত হচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ পড়াশোনা শেষ করে পূর্ণাঙ্গভাবে মৌসুমি ফল ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।
আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ করোনার এ বেকার সময়কে কাজে লাগাচ্ছেন মৌসুমি ফল ব্যবসায়।
‘ই-প্রতিবেশী’
দিনাজপুর কেন্দ্রিক একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।
করোনা শুরুর দিকে লকডাউনে মানুষের বাসার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিশেষ করে কাঁচাবাজারে পৌঁছে দেয় তারা।
এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জানান, এ বছর লিচুর মৌসুম শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লিচুর ফরমায়েশ আসতে শুরু করে।
এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজার লিচু তার প্রতিষ্ঠান ঢাকা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ার করেছেন।
মোহাম্মদ মাকসুদ পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন বেশ কয়েক বছর।
চাকরি ছেড়ে ধান-চালের ব্যবসায় নামেন তিনি।
ঢাকায় চাকরির সুবাদে অনেকের সঙ্গে পরিচয়।
পরিচিত ও আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে লিচুর ফরমায়েশ আসতে থাকে।
ধান-চালের ব্যবসার পাশাপাশি লিচু ও আমের মৌসুমে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ফল পাঠান তিনি।
তিনি জানান, প্রথমদিকে ঢাকার পরিচিত আত্মীয়-স্বজনদের কাছে লিচু পাঠাতাম।
ধীরে ধীরে আমার ফেসবুকে অপরিচিত গ্রাহকদের লিচুর চাহিদা আসতে থাকে।
গত বছরের তুলনায় এ বছর লিচুর চাহিদা অনেক বেশি।
মাকসুদ জানান, গ্রামের বাসায় আমার নিজেরই কিছু লিচু গাছ আছে।
চাহিদা বাড়ায় গত বছর গ্রামের দুটি লিচু বাগান লিজ নিয়েছেন তিনি।
বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মামুর।
অনলাইনে ফুড প্যারাডাইস নামে একটি ফেসবুক পেজ চালান তিনি।
শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজে গড়ে তুলেছেন আম ও লিচুর বাগান।
প্রতি বছর নিজের বাগান থেকে অনলাইনে আম ও লিচু বিক্রি করেন তিনি।
গত বছর অনলাইনে বিক্রি শুরু হলেও চলতি মৌসুমে প্রচুর লিচুর অর্ডার পেয়েছেন তিনি।
মামুর বলেন, অনলাইন ব্যবসার শুরুর দিকে ক্রেতাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কারণ মৌসুমি ফল সাধারণত পচনশীল।
সঠিক পণ্য নির্বাচন, প্যাকেজিং ও সর্বোপরি কুরিয়ার ডেলিভারি একটু এদিক-সেদিক হলেই পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তখন ক্রেতারা সচরাচর বিক্রেতাকেই দোষারোপ করে থাকেন।
আমি পণ্য পাঠানোর আগে ক্রেতার মনোনীত কুরিয়ারকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি।
ক্রেতারা সরাসরি আমার বাগানের আম ও লিচু দেখে অর্ডার দিতে পারে।
দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক প্রদীপ কুমার গুহ জানান, চলতি বছর দিনাজপুর জেলায় ৫ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে।
আকার ও স্বাদে অতুলনীয় দিনাজপুরের লিচুর সমাদর ও চাহিদা দেশজুড়ে।
বিশেষ করে বেদানা, চায়না টু ও থ্রি, মোজাফফরপুরী ও হাড়িয়া বেদানা লিচুর চাহিদা প্রতি বছর বাড়ছে।
আড়তে পাইকারি বেচা-কেনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে লিচু বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে।
এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে।
অনলাইনে অনেক সময় ভালো পণ্য দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ পুরনো।
এক্ষেত্রে নতুনদের চেয়ে পরিচিত ফেসবুক পেজ অথবা আত্মীয়দের কাছ থেকে বেশি লিচু কিনছেন তারা।
তিনি আরো জানান, এ বছর দিনাজপুর জেলায় ৩৩ হাজার ৪৮৪ টন লিচু উৎপাদন হয়েছে।
প্রতি টন লিচু ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা দর হিসেবে দিনাজপুর জেলায় প্রায় ৪৮২ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়েছে।