আমাদের
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
নিয়ে সবার
অভিযোগের অন্ত
নেই। অভিযোগ
থাকার কারণও
আছে অনেক।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা
হয় না,
আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে
তাদের ঠাঁই
হয় না,
এমনকি অনেক
ক্ষেত্রে টারশিয়ারি
অথবা আন্ডার
গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাও
যুগোপযোগী হয়
না। এর
ওপর আছে
শিক্ষা নিয়ে
দুর্নীতি এবং
বাণিজ্য। আমরা
সাধারণত দেশের
সব বিশ্ববিদ্যালয়কে
একই কাতারে
ফেলে একই
মানদণ্ডে বিচার
করে থাকি।
নামে সবই
বিশ্ববিদ্যালয় হলেও
কার্যপরিধি আসলে
এক নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রক
সংস্থাই বিভিন্ন
ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের
কার্যপরিধি ভিন্নভাবে
নির্ধারণ করে
রেখেছে।
বর্তমান বিশ্বে
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
ভূমিকা প্রধানত
দুটি। টারশিয়ারি
পর্যায়ের শিক্ষা
দেয়া এবং
গবেষণা ও
নতুন জ্ঞান
সৃষ্টি। অনেক
দেশই কলেজ
আর বিশ্ববিদ্যালয়
এ দুই
ভূমিকা আলাদাভাবে
পালন করে।
কলেজগুলো টারশিয়ারি
পর্যায়ের শিক্ষা
দেয় আর
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা
ও জ্ঞান
সৃষ্টি নিয়ে
কাজ করে।
কলেজগুলো আবার
নিজেদের শিক্ষার্থীদের
নিজেরা ডিগ্রি
দিতে পারে
না। ডিগ্রি
দেয়া হয়
এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে। যেমন
ভারতে এ
মডেল প্রতিষ্ঠিত।
আবার যুক্তরাষ্ট্রে
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একই
সঙ্গে টারশিয়ারি
পর্যায়েও পড়ায়,
আবার গবেষণাও
করায়। সেই
সঙ্গে শুধু
টারশিয়ারি পর্যায়ে
শিক্ষা দেয়া
হয়, এমন
কলেজও যুক্তরাষ্ট্রে
আছে। আমাদের
দেশে জাতীয়
(ও কয়েকটি
অন্যান্য) বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধীনে কলেজগুলোয়
টারশিয়ারি পর্যায়ে
পড়ানো হয়।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
মূল কাজও
এখানে টারশিয়ারি
পর্যায়েই পড়ানো,
যদিও সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা
করার এবং
এমফিল, পিএইচডি
ডিগ্রি দেয়ার
সুযোগ অন্তত
কাগজে-কলমে
আছে। ফলে
কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের
মধ্যে পার্থক্য
নিয়ে আমাদের
মাঝে অনেক
বিভ্রান্তি বিদ্যমান।
এ বিভ্রান্তির
সবচেয়ে বড়
শিকার দেশের
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
টারশিয়ারি পর্যায়ে
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
চেয়ে অনেক
বেশিসংখ্যক ছাত্রী
পড়ানোর পরেও
তাদের পরিচয়
নিয়ে দ্বন্দ্ব
সমাজের সব
মহলেই থেকেই
যাচ্ছে। ব্যাপারটা
একটু খোলাসা
করি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
এ দেশে
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে
স্বীকৃতি পেয়েছে।
কেননা তাদের
নিজেদের ছাত্রীদের
নিজেরাই ডিগ্রি
দিতে পারে।
কলেজগুলোর মতো
ডিগ্রি দেয়ার
জন্য তাদের
অন্যের দ্বারস্থ
হতে হয়
না। কিন্তু
এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
কোনো একাডেমিক
স্বাধীনতাই নেই।
একটি বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন
কোন বিযয়
পড়ানো হবে,
ওই বিষয়গুলোর
কারিকুলাম কী
হবে, কী
কী ডিগ্রি
দেয়া যাবে,
কোনো সিদ্ধান্তই
সেই বিশ্ববিদ্যালয়
নিজেরা নিতে
পারে না।
সবকিছুই নির্ধারণ
করে দেয়
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রক
সংস্থা। সবচেয়ে
বড় কথা,
বাংলাদেশে কোনো
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
এমফিল, পিএইচডি
কার্যক্রম চালাতে
পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রক
সংস্থা বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেই
অনুমতি দেয়নি।
যে প্রতিষ্ঠানের
কোনো একাডেমিক
স্বাধীনতা নেই,
যে প্রতিষ্ঠানের
পিএইচডি কার্যক্রম
চালানোর অনুমতি
নেই, সেই
প্রতিষ্ঠান গবেষণাই
করাবে কীভাবে
আর নতুন
জ্ঞানই-বা
সৃষ্টি করবে
কীভাবে? গবেষণা
আর পোস্ট
গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা
তো জৈবিকভাবে
একে অন্যের
সঙ্গে বাঁধা।
বিপদে পড়লে
গাধা দিয়ে
যতটুকু হালচাষ
করা যায়,
আন্ডার গ্র্যাজুয়েট
ছাত্রী দিয়ে
অথবা কোনো
ছাত্রী ছাড়াই
কেবল শিক্ষক
দিয়ে একটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে ততটুকুই
গবেষণা করা
যায়। তার
চেয়ে বেশি
নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
পরিচয় সংকটের
মূল এখানেই।
নামে তারা
বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু
কাজে তারা
কলেজের বেশি
কিছু নয়।
সমাজ তাদের
কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের
আদর্শ ভূমিকা
আশা করে,
এমনকি অনেক
ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ অথবা
প্রতিষ্ঠাতারাও তাই
আশা করেন।
আশা করেন
আন্তর্জাতিক র্যাংকিং,
যেগুলো নির্ধারিত
হয় প্রধানত
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা
অর্জনের ওপর
ভিত্তি করে।
এ দেশের
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
সম্মানজনক অবস্থানে
থাকবে। কিন্তু
সেই আশা
আর বাস্তবায়ন
হয় না।
বর্তমান কাঠামোর
মধ্যে তা
বাস্তবায়ন সম্ভব
হওয়ার আদৌ
কোনো সুযোগ
আছে বলেও
মনে হয়
না। মাঝখান
দিয়ে ভালো
কলেজ হিসেবে
দায়িত্ব পালন
করা বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও চিহ্নিত
হয় ব্যর্থ
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে।
এ সংকট
উত্তরণের উপায়
হতে পারে
দুটি। প্রথমত,
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
যেন বিশ্ববিদ্যালয়
হিসেবে ভূমিকা
রাখতে পারে
সেজন্য তার
একাডেমিক ক্ষমতায়ন
করা, নিয়ন্ত্রক
সংস্থার আমলাতান্ত্রিক
নিয়ন্ত্রণ থেকে
তাকে মুক্তি
দেয়া। সেই
সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষের গবেষণার
জন্য কী
প্রয়োজন, তা
মাথায় রেখে
সেই অনুযায়ী
সিদ্ধান্ত নেয়া।
দ্বিতীয়ত, সমাজ
যদি মনে
করে উচ্চশিক্ষায়
দুর্নীতি কমানোর
জন্য বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার
সুযোগ সৃষ্টির
চেয়ে এ
প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর
কঠিন নিয়ন্ত্রণ
বেশি জরুরি,
তাহলে বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়
হিসেবে পূর্ণ
দায়িত্ব পালন
করবে—এ
অবাস্তব আবশ্যকতা
থেকে তাদের
মুক্তি দেয়া।
শুধু কলেজ
হিসেবে তাদের
ভূমিকার ওপর
মূল্যায়ন করা,
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও
সেই বাস্তবতা
মেনে নেয়া।
পরিশেষে আরেকটি
বিষয়ের ব্যাখ্যা
না দিলেই
নয়। কয়েক
বছর ধরে
আমরা নিয়মিতভাবে
দেখতে পাচ্ছি
যে বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান
র্যাংকিংয়ে, যেমন
কিউএস অথবা
স্কিম্যাগো র্যাংকিং,
বাংলাদেশের কয়েকটি
বিশ্ববিদ্যালয় নিচের
দিকে স্থান
পেয়ে আসছে,
যদিও গবেষণায়
অর্জন এসব
র্যাংকিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করে। এ
তালিকায় কয়েকটি
নামকরা সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি
কয়েকটি বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ও কিন্তু
ধারাবাহিকভাবে একই
কাতারে জায়গা
করে নিয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন
উঠতে পারে
যে পিএইচডি
প্রোগ্রাম ছাড়াই
যদি কিছু
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
র্যাংকিংয়ে জায়গা
করে নিতে
পারে এবং
পিএইচডি প্রোগ্রাম
থাকার পরেও
যদি অনেক
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
র্যাংকিংয়ে ঢুকতে
না পারে,
পিএইচডি ডিগ্রি
দিতে পারা
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার
জন্য আদৌ
জরুরি কোনো
বিষয় কিনা।
আসলে পোস্ট
গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম
থাকা গবেষণার
জন্য একটি
প্রয়োজনীয় শর্ত।
তবে যথেষ্ট
নয়। এর
পরেও আরো
অনেক কিছুর
দরকার হয়।
যেমন যোগ্য
শিক্ষক, ভালো
ছাত্রী, ল্যাবরেটরি
ও অন্যান্য
ভৌত অবকাঠামো,
বাজেট এবং
সর্বোপরি গবেষণা
করার আকাঙ্ক্ষা।
তাছাড়া আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিংয়ের
যে পর্যায়ে
থাকে (যেমন
এশিয়ায় সেরা
পাঁচশর মাঝে),
তা খুব
গুরুত্বপূর্ণ কোনো
গবেষণার চিত্র
তুলে ধরে
না। বিশ্ববিদ্যালয়ের
অল্প কয়েকজন
শিক্ষকের ব্যক্তিগত
উদ্যোগে নেয়া
গবেষণা দিয়েই
সেখানে যাওয়া
সম্ভব। র্যাংকিংয়ে
ঠাঁই পেলেই
সরকারি, বেসরকারি
কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই
আত্মশ্লাঘা বোধ
করার কিছু
নেই, যতক্ষণ
না সেই
অবস্থান একটি
প্রাতিষ্ঠানিক সুনির্দিষ্ট
গবেষণা নীতিমালা
ও কার্যক্রমের
ফসল হচ্ছে।
ড. আনিসুল হক: অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি