পরিশোধন কেন্দ্র তৈরিতে বিএডিসির উদ্যোগ

কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়াতে দ্রুত বাস্তবায়ন হোক

আম সবজিসহ উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মান বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) পণ্য পরিশোধনে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। -সংক্রান্ত একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে কৃষিমন্ত্রী রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আম উৎপাদন এলাকায় চারটি ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য মোড়কজাতের প্রক্রিয়াটা হবে অটোমেটিক মেশিনে। সেখানে হাতের স্পর্শ ছাড়াই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ফল সবজিতে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া এবং বিভিন্ন পোকামাকড়ের ডিম থাকে। বাষ্প তাপ প্রয়োগ প্লান্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া এর ডিম ধ্বংস করা যাবে। এছাড়া প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে এসব সতেজ কৃষিপণ্যের সংরক্ষণকালও বাড়বে প্রক্রিয়ার ফলে দেশের রফতানিযোগ্য আম-সবজিসহ বিভিন্ন সতেজ পণ্যের প্রতি বিদেশী আমদানিকারকরা আরো আগ্রহী হবেন। কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে, কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া গেলে বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্লান্ট স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, দ্রুতই এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি পণ্য উৎপাদন থেকে বাজারজাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডও অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশের আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে রাশিয়ায়। কিন্তু কয়েক বছর আগে আলুতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়ায় দেশটি বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ইউরোপের বাজারে দেশী লেবু, ঢেঁড়স বেগুনের মতো অনেক সবজি রয়েছে পছন্দের তালিকায়। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়ও রয়েছে বাংলাদেশী সবজির চাহিদা। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই আম বেশ জনপ্রিয়। প্রক্রিয়াকরণে দুর্বলতার কারণে এসব বাজার অধিকারে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে সবজি ফল রফতানির সম্ভাবনা থাকলেও কিছু সমস্যার কারণে সে সুযোগ সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। মান-সংক্রান্ত সমস্যা তো রয়েছেই। তবে রফতানি কাজের ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বিমানবন্দরে বিশেষ স্ক্যানার না থাকায় সমস্যা বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মান সনদ-সংক্রান্ত সমস্যা দূর করা গেলে শাকসবজি, ফলমূল, শুকনো বা প্রক্রিয়াজাত খাবারের রফতানি আরো বাড়বে। বর্তমানে কোনো কোনো প্রক্রিয়াজাত খাবার রফতানির জন্য বিদেশ থেকে সনদ সংগ্রহ করতে হয়। এতে সময় অর্থ দুটোই বেশি লাগে। আবার অনেকে তাও সংগ্রহ করতে পারেন না। ফলে সরকার রকম একটি সংস্থা বা ল্যাব স্থাপন করলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি রফতানি আয় বাড়বে। খাতে রফতানির বাজার আরো বাড়াতে চাইলে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার দরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যে কোয়ারেন্টিন সার্টিফিকেট দেয়, তার ওপর অনেক দেশেরই আস্থা নেই। তবে আশার কথা হলো, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানিতে সহযোগিতা করতে একটি বিশেষ ল্যাবরেটরি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরীক্ষাগারে পণ্যের মান পরীক্ষা করে রফতানি সনদ দেয়া হবে। প্রক্রিয়াটি শুধু উদ্যোগে আটকে থাকলেই হবে না, দ্রুতই এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

ইথেনিক সুপারবিশ্বে দুই ধরনের সবজির বাজার আছে। বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশীরা বসবাস করে, তারাই শাকসবজির বড় ক্রেতা। বাজারকে বলা হয় ইথেনিক। বাংলাদেশের সবজির বাজার মূলত ইথেনিকভিত্তিক। আর বিদেশী ক্রেতাদের বাজারকে বলা হয় সুপার। তবে বাংলাদেশের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ গুণগত মান ঠিক রেখে তা রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সুপার বাজার ধরা সম্ভব হচ্ছে না। রফতানি বাড়াতে হলে মানসম্মত সবজি ফল উৎপাদন করতে হবে। কারণ বিদেশীরা চান উত্তম কৃষির পরিচর্যা বা গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পদ্ধতি অনুসরণ করে বিশ্বমানের উপযোগী স্বাস্থ্যসম্মত শাকসবজি উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে। তবে সংশ্নিষ্ট রফতানিকারকরা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, কার্গো উড়োজাহাজ নেই। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে জায়গা কম থাকে। এছাড়া বাংলাদেশ বিমানের ঘন ঘন সময়সূচির পরিবর্তন, অবকাঠামো সমস্যা, অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে দেশী শাকসবজির খরচ বেড়ে গেছে। এতে ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনে যে ধরনের সক্ষমতা দরকার, আমাদের তা নেই। ইউরোপের ভোক্তারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন। রোগবালাইমুক্ত খাদ্যপণ্য খেতে চান। মানসম্মত উপায়ে চাষ করে শাকসবজি রফতানি করতে পারলে খাতে আয় বর্তমানের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে অনেক ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট গড়ে উঠেছে। ব্যক্তি খাতে গড়ে ওঠা এসব প্লান্ট ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে কিনা, তা দেখভাল লাইসেন্স প্রদান করে কেন্দ্রীয় রাজ্য সরকার। বছর বছর লাইসেন্স নবায়নও করতে হয় তাদের। এর ফলে ট্রিটমেন্ট প্লান্টগুলো সঠিকভাবে কাজ করে। বাংলাদেশেও বেসরকারি উদ্যোগে এমন ট্রিটমেন্ট প্লান্ট গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে দেশের কয়েকটি এলাকা বিশেষত যেখান থেকে সবজি ফল রফতানির সুযোগ রয়েছে, সেখানে এমন প্লান্ট গড়ে তোলা প্রয়োজন। যেসব ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান খাতে বিনিয়োগ করতে চায়, তাদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে। বড় বিষয় হলো, প্লান্ট স্থাপন করলেই হবে না, সেটি পরিচালনা কীভাবে পণ্য জীবাণুমুক্ত করা হবে, তার পূর্ণাঙ্গ বিধিমালাও প্রণয়ন করতে হবে। ভারত সরকার ২০০৫ সালেই প্লান্ট স্থাপন পরিচালনাসংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়ন এবং তার সফল বাস্তবায়ন করছে। আমরাও সেটি অনুসরণ করতে পারি। বড় বিষয় হলো, প্লান্ট পরিচালনায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে হবে। হাতের স্পর্শ ছাড়া পণ্য মোড়কজাত এবং যথাযথ তাপমাত্রায় সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে এটি ব্যবহারের ব্যয়ও সাধ্যের মধ্যে নির্ধারণ করতে হবে। নইলে রফতানিকারক বা কৃষকরা প্লান্ট ব্যবহারে উৎসাহী হবেন না। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে কার্গো-স্বল্পতা, মান সনদ প্রদানের গবেষণাগার প্রভৃতি বিষয়েও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক যে মানদণ্ড রয়েছে, সেটি পরিপালনে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে শুধু প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে রফতানি বাড়ানো যাবে না। এটি ব্যবহারেও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন