এশিয়ার বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও তাপ কয়লার দাম সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লাফিয়ে বেড়েছে। মূলত বলিষ্ঠ চাহিদা জ্বালানি পণ্য দুটির বাজারদরকে ঊর্ধ্বমুখী করছে। উত্তোলকদের জন্য এটি ভালো খবর হলেও এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য দীর্ঘমেয়াদি আশীর্বাদ বয়ে আনবে। খবর রয়টার্স।
এশিয়ান স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। শীত মৌসুমে জ্বালানি পণ্যটির প্রতি ১০ লাখ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিটের (বিটিইউ) দাম ছিল ৫ ডলার ৬০ সেন্ট। সম্প্রতি দাম দ্বিগুণ বেড়ে ১০ ডলার ৯৫ সেন্টে উঠে এসেছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদাই মূল্যবৃদ্ধিতে জ্বালানি জুগিয়েছে।
পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রেফিনিটিভ জানায়, চলতি বছরের মে মাসে এশিয়া অঞ্চলের বন্দরগুলোতে ২ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন এলএনজি খালাস করা হয়েছে। এপ্রিলে খালাস করা হয় ২ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার টন। এছাড়া গত বছরের মে মাসে খালাস করা হয় ১ কোটি ৮৯ লাখ ৬০ হাজার টন। অর্থাৎ মাসিক ও বার্ষিক উভয় হিসেবেই এলএনজি আমদানি বাড়িয়েছে এশিয়ার দেশগুলো।
এশিয়ায় চাহিদা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে চীন। এপ্রিলে দেশটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার টন এলএনজি আমদানি করে। মে মাসে আমদানির পরিমাণ বেড়ে ৭৩ লাখ ১০ হাজার টনে উন্নীত হয়, যা চলতি বছরের জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। দেশটি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৩২ লাখ ২০ হাজার টন এলএনজি আমদানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি। ওই সময় আমদানি করা হয়েছিল ২ কোটি ৫৬ লাখ ২০ হাজার টন এলএনজি।
এশিয়ার বাজারে এলএনজির পাশাপাশি তাপ কয়লার দামের ঊর্ধ্বগতিও ত্বরান্বিত করেছে চীন। যদিও চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির তাপ কয়লা আমদানি কমেছে।
দেশটির রাজস্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে চীন সব মিলিয়ে ২ কোটি ১৭ লাখ ৩০ হাজার টন কয়লা আমদানি করেছিল। মে মাসে আমদানি কমে ২ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার টনে নেমে যায়। এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশটি মোট ১১ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টন কয়লা আমদানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ কম।
বিশ্বের শীর্ষ কয়লা আমদানিকারক দেশ চীন। দেশটি কয়লা আমদানি কমিয়ে দেয়ায় এশিয়ার বাজারে বড় প্রভাব পড়তে পারে। তবে বাজার চাঙ্গা রাখার কৌশল হিসেবেই দেশটি আমদানি কমিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বের তাপ কয়লা সরবরাহকারী শীর্ষ দেশ ইন্দোনেশিয়ার পরই অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান। দেশটি থেকে তাপ কয়লা আমদানিতে চীনের অপ্রাতিষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে চীন তাপ কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে ইন্দোনেশিয়া ও রাশিয়াকে বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশ দুটি তাদের কয়লার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে দাম বাড়িয়ে দেয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ কয়লা আমদানিকারক দেশ ভারত ইন্দোনেশিয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পরিবর্তে দেশটি অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করছে। পাশাপাশি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার উন্নত মানের কয়লার চাহিদা বেড়েছে। মূলত এসব কারণেই এশিয়ার বাজারে কয়লার দাম আকাশচুম্বী।
পণ্যের মূল নিরূপণকারী সংস্থা আরগাস জানায়, ৪ জুন নিউক্যাসল বন্দরে অস্ট্রেলিয়ার উচ্চ মানসম্পন্ন তাপ কয়লার দাম এক দশকের শীর্ষে উঠে আসে। এ সময় জ্বালানি পণ্যটির টনপ্রতি মূল্য বেড়ে ১২১ ডলার ৪৮ সেন্টে দাঁড়ায়। গত বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে তিনগুণ। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার নিম্নমানের কয়লার দামও লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। জুনের শুরুর দিকে পণ্যটির দাম গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১৪৩ শতাংশ বেড়ে টনপ্রতি ৫৫ ডলার ৪ সেন্টে উন্নীত হয়।
এলএনজি ও তাপ কয়লার এমন মূল্যবৃদ্ধি উত্তোলক দেশগুলোর জন্য খুশির সংবাদ বয়ে এনেছে। মহামারীর ধাক্কায় যে লোকসানের মুখে পড়েছিল, তা পুষিয়ে নিচ্ছে এসব দেশ। তবে বিশ্বজুড়ে কার্বণ নিসঃরণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কমছে কয়লাসহ অপরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার। বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি।
অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থা সিএসআইআরও এবং দেশটির জ্বালানি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, একটি নতুন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উচ্চমানসম্পন্ন কয়লা ব্যবহার করে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উত্পন্ন করতে ব্যয় হয় ৪ হাজার ৪৫০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যয় হয় ১ হাজার ৮০১ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। এক্ষেত্রে বড় ধরনের সোলারের মাধ্যমে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হবে মাত্র ১ হাজার ৪০৮ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। বায়ুবিদ্যুতের ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ ১ হাজার ৯৫১ অস্ট্রেলিয়ান ডলার।
এছাড়া এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় নেই। পরিচালনার জন্য খুব বেশি শ্রমিকেরও প্রয়োজন হয় না। ফলে কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় এটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী। তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কার্বণ নিসঃরণের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাবও তৈরি করবে না। ফলে এলএনজি ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধি উত্তোলকদের জন্য সাময়িক ভালো সংবাদ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য নতুন যুগের সূচনা করছে।