কলকাতা-করাচিতে থাকলেও ঢাকায় নেই আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা

সাইফ বাপ্পী ও আল ফাতাহ মামুন

চারশ বছরেরও পুরনো নগরী ঢাকা এক সময় ছিল উপমহাদেশের বৃহৎ এক বাণিজ্য কেন্দ্র। ঢাকা তথা বাংলার ঐশ্বর্যের টানে এখানে ব্যবসা করতে এসেছেন অনেক বিদেশী। আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও করেছেন কেউ কেউ। ঢাকায় এখন আর সেসব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা যায় না। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সে বণিক সম্প্রদায়গুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক পর্ব- 

আর্মেনীয়রা ঠিক কোন বছর প্রথম ঢাকায় পা রাখে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বিভিন্ন নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয়, আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা ঢাকায় বাণিজ্য শুরু করেন সপ্তদশ শতকের প্রথমে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা এখানে এসে বসত গড়েন। ওই সময় বঙ্গ তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই ঢাকা ছিল জমজমাট এক বাণিজ্য কেন্দ্র। ঢাকার বাণিজ্যিক অবয়বই এখানে টেনে নিয়ে এসেছিল জাত ব্যবসায়ী আর্মেনীয়দের। আরব সাগর তীরবর্তী বন্দরনগরী করাচি তখনো গড়ে ওঠেনি। হুগলি তীরবর্তী অখ্যাত তিনটি গ্রাম তখনো নগর কলকাতায় রূপ নেয়ার জন্য ব্রিটিশদের অপেক্ষায়। জাত ব্যবসায়ী আর্মেনীয়দের জন্য গন্তব্য হিসেবে ঢাকা ছিল আদর্শ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বর্তমানে করাচি বা কলকাতায় আর্মেনীয়দের দেখা গেলেও ঢাকায় এখন আর বসবাস করছেন না তারা।

উপমহাদেশে এখন স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে আর্মেনীয়দের চোখে পড়ে শুধু ভারত পাকিস্তানে। এর মধ্যে ভারতে অবস্থানকারী আর্মেনীয়দের অধিকাংশেরই বসবাস কলকাতায়। প্রায় ১৫০ জন আর্মেনীয় বাসিন্দা সেখানে বসবাস করছেন। পাকিস্তানের করাচি ছাড়াও লাহোর ইসলামাবাদেও কিছুসংখ্যক আর্মেনীয়ের দেখা মেলে। তবে তাদের অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে মিশে যাওয়ায় সেভাবে আলাদা করা মুশকিল।

অথচ তিন শতকেরও বেশি সময় ধরে আর্মেনীয়রা ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনে নগরীর প্রতাপ ধীরে ধীরে কমলেও জৌলুস ধরে রেখেছিল আর্মেনীয়রা। এখানে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে সম্পদশালী হয়ে উঠেছেন তারা। জমিদারি কিনেছেন। বাড়িয়েছেন প্রভাব-প্রতিপত্তিও। জায়গা করে নিয়েছেন নগরীর নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে। এমনকি ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিরও সদস্য হয়েছিল আর্মেনীয়রা। তাদের গড়ে তোলা স্কুল-গির্জাসহ বিভিন্ন স্থাপনা এখন নগরীর দর্শনীয় পুরাকীর্তি। এসব স্থাপনা ঢাকার আর্মেনীয়দের গৌরবগাথার নিদর্শন। যদিও এগুলোর নির্মাতা সম্প্রদায়ের কোনো সদস্যকেই এখন আর ঢাকায় চোখে পড়ে না।

ঢাকার আর্মেনীয় গির্জার তত্ত্বাবধায়ক মাইকেল জোসেফ মার্টিনের মৃত্যু হয় গত বছর। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার আর্মেনীয়দের তিন শতাধিক বছরের অধ্যায়েরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

ইতিহাস বলছে, অধ্যায়ের সূচনাকাল পারস্যের সাফাভিদ নরপতি শাহ আব্বাসের (১৫৮৮-১৬২৯) সময়ে। ওই সময় প্রায় ৪০ হাজার আর্মেনীয় বণিককে আশ্রয় দেন তিনি। ভাগ্যান্বেষী পারসিকদের সঙ্গে তাদের একাংশ এসে থিতু হয় বাংলায়। তাদের মধ্যে আবার বড় একটি অংশ পাড়ি জমায় ঢাকায়।

প্রথম দিকে ঢাকার আর্মেনীয়রা বসবাস করত পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার নলগোলার দিকে। পরে তারা আরমানিটোলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

অষ্টাদশ শতকের গোড়ার মধ্যেই আর্মেনীয়দের ঢাকাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। বিদেশী বণিকদের মধ্যে অগ্রগামী হয়ে ওঠে আর্মেনীয়রা। পূর্ববঙ্গের বস্ত্র শিল্প তখন গোটা বিশ্বে বিখ্যাত। ইতিহাস বলছে, ১৭৪৭ সালে ঢাকা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানীকৃত বস্ত্রের ২৭ শতাংশই করেছিল আর্মেনীয়রা। ছয়টি আর্মেনীয় জাহাজ তখন বাংলার বন্দর থেকে সুরাট, জেদ্দা, বসরা, মসুলিপট্টমসহ বিভিন্ন গন্তব্যে বস্ত্র রেশম নিয়ে যেত। সিল্কের ব্যবসায় একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা। এছাড়া লবণ, চামড়া, নীল, পাট, তিল-সরিষা, ঠিকাদারি ইউরোপ থেকে পণ্য আমদানির ব্যবসাতেও নিযুক্ত হয়েছিল তারা। ওই সময় তারা তত্কালীন হিসেবেই ঢাকা থেকে বছরে - লাখ টাকার বস্ত্র রফতানি করতেন। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে তা - লাখ টাকাও বলা হয়েছে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে দেশের বস্ত্র শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮১৭ সালের পর ঢাকাই বস্ত্র শিল্পে ব্যাপক মন্দা দেখা দেয়। ওই সময়ে ঢাকার আর্মেনীয়রা বিনিয়োগ শুরু করে জমিজমায়। উনিশ শতকের প্রথমদিকে আর্মেনীয় জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন আগা আরাতুন মাইকেল। ১৮২৩ সালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মারা যান তিনি। ওই সময়ের হিসাবেই তিনি তখন কোটিপতি। এছাড়া ইতিহাসের গ্রন্থগুলোয় নিকোলাস মারকার পোগোজ নামে আরেক প্রভাবশালী আর্মেনিয়ান জমিদারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঢাকা ছাড়াও বাখরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জালালপুর ত্রিপুরায় তার জমিদারি ছিল। এছাড়াও সারকিস, আরাতুন, স্টিফেন, লাজারসসহ আরো কয়েকটি আর্মেনীয় পরিবার জমিদারি করে বেশ ভালো আয় করে।

ঢাকার আর্মেনীয়রা যে ব্যবসাতেই হাত দিয়েছে, সেখানেই সফল হয়েছে বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদ . শরীফ উদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বস্ত্র ছাড়াও অন্য যেসব ব্যবসায় আর্মেনীয়দের হাতের ছোঁয়া লেগেছে, সেসবেও তারা জাদুর মতো সফল হয়েছেন। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে, তখন থেকেই ঢাকার মায়া কাটাতে শুরু করে আর্মেনীয়রা। তারা তখনই আঁচ করতে পারে, ঢাকা তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে আসছে। তবুও টিকে থাকার চেষ্টা হিসেবে তারা বস্ত্র ছেড়ে জমিদারি শুরু করে। আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব কমে যাওয়ার পর পাট ব্যবসা শুরু করেন তারা। এতেও রাতারাতি সফলতার দেখা পান।

বাংলার পাটের সম্ভাবনাকেও ভালোই বুঝতে পেরেছিল আর্মেনীয়রা। বিখ্যাত ঢাকা গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জানাচ্ছেন, আর্মেনীয়রা টিকে থাকার জন্য সর্বশেষ পাটের ব্যবসা করে। এর আগে তারা লবণের ব্যবসাও ধরেছিলেন।

তবে পাটের ব্যবসায় তাদের সাফল্য ছিল আরো বেশি। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আর্মেনীয়রা ঢাকা নারায়ণগঞ্জ থেকে পাট কিনে কলকাতায় পাঠাতো। বেশি লাভের জন্য দালাল পাইকারদের ডিঙিয়ে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকেই পাট কিনতেন তারা। তাদের মধ্যে একটি প্রবণতা ছিলযেখানেই তারা ব্যবসার জন্য যেতেন, সেখানেই স্থানীয়দের ভাষা শিখে নিতেন। প্রবণতার কারণে চাষীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে তাদের অসুবিধা হতো না।

বিভিন্ন পুস্তক নথির তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭৫ সালে মারগার ডেভিড মাইকেল সারকিস নামে দুই আর্মেনীয় ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জে যথাক্রমে এম ডেভিড অ্যান্ড কোং এবং এম সারকিস অ্যান্ড সন্স নামে দুটি পাট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের প্রায় ১২ জন বিশিষ্ট আর্মেনীয় পাট ব্যবসায়ীর তথ্য পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন আব্রাহাম পোগোস, মারগার ডেভিড, জেসি সারকিস, এম ক্যাটচাটুর, টমাস, জেজিএন পোগোজ, মাইকেল সারকিস পি আরাতুন।

আর্মেনিয়ানদের মধ্যে শীর্ষ পাট ব্যবসায়ী ছিলেন মারগার ডেভিড। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বরানগর নামের একটি জাহাজ সে সময়ের হাজার পাউন্ড মূল্যে কিনে নিয়েছিলেন তিনি। বিলাসবহুল জাহাজটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ছিল অনেক। ব্রিটিশরা তা বহন করতে পারছিল না। সে সময় জাহাজটিকে কিনে নিয়ে নিজের ব্যবসার কাজে লাগান মারগার ডেভিড।

ইতিহাসবিদ . শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বস্ত্রের পর পাট ব্যবসায়ও আর্মেনিয়ানরা রমরমা লাভের মুখ দেখে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢাকার বস্ত্র ব্যবসাকে মন্দায় পরিণত করার ফলে ঢাকার জীবনমান সংস্কৃতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আর্মেনিয়ানরা পাটের ব্যবসা করে ঢাকাকে আবার ব্যবসাসফল শহরে রূপ দেয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর্মেনিয়ানরাই ঢাকায় পাট বাণিজ্যের সূচনা করে।

তিনি বলেন, ঢাকায় আর্মেনীয়রা কোনো সময়ই সংখ্যায় ১৫০ জনের বেশি ছিলেন না। বস্ত্র ব্যবসার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেলে অনেকেই ঢাকা ত্যাগ করে। যারা ছিলেন তারা পাট ব্যবসা আঁকড়ে ধরে টিকে থাকে। বিশ শতকের শুরুতে ইংরেজরা ঢাকার পাট ব্যবসা নিজেদের দখলে নিলে অবশিষ্টদের একাংশও ঢাকা ছেড়ে যায়। দেশভাগের সময় বাকিরা কলকাতা চলে যায়।

ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের তত্ত্বাবধায়ক মাইকেল জোসেফ মার্টিন ২০১০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন, ওই সময়ে বাংলাদেশে মাত্র আটটি আর্মেনিয়ান পরিবার ছিল।

তবে মুহূর্তে বাংলাদেশে কতগুলো আর্মেনীয় পরিবার বসবাস করছে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য কারো কাছে নেই।

আরমানিটোলার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আর্মেনীয় গির্জায় ধর্মচর্চা ছাড়া ঢাকার আর্মেনীয়দের শেষ পরিবারগুলোকে অন্য কোথাও তেমন একটা দেখা যেত না। তবে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বণিক বার্তা জানিয়েছেন, দেশভাগের পর ঢাকায় উল্লেখ করার মতো কোনো আর্মেনিয়ান পরিবার ছিল না।

বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আর্মেনীয় গির্জার পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখন ঢাকায় কোনো আর্মেনিয়ান বসবাস করছেন না। ১৯৮০ সালে গির্জার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগ দেয়া মাইকেল জোসেফ মার্টিনই ছিলেন ঢাকার শেষ আর্মেনিয়ান। তিনি ২০১৫ সালে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা ত্যাগ করেন। কানাডায় গত বছর মৃত্যু হয় তার। ৮৯ বছর বয়সে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন