মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ই-বর্জ্য বা মেয়াদোত্তীর্ণ-অব্যবহূত ইলেকট্রনিক সামগ্রী ছয় মাসের বেশি মজুদ রাখা যাবে না। রফতানি করা গেলেও ই-বর্জ্য আমদানি কিংবা দান-অনুদান হিসেবেও গ্রহণ করা যাবে না। এসব বিষয় নির্দিষ্ট করে সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহ কেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনর্ব্যবহার উপযোগীকরণকারী ই-বর্জ্য ১৮০ দিন বা ছয় মাসের বেশি মজুদ করতে পারবে না। তবে কোনো চূর্ণকারী এবং পুনর্ব্যবহার উপযোগীকারীর বার্ষিক মজুদ সক্ষমতা যদি বেশি এবং পরিবেশবান্ধব হয়, তাহলে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরো তিন মাস সময় বৃদ্ধি করা যাবে।
ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করতে অনেক দিন থেকেই বিশেষজ্ঞরা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালার বিষয়ে জোর দিয়ে আসছিলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় চার লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ১২ লাখ টনে পরিণত হবে। এসব বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে গিয়ে প্রতি বছর ১৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। আর স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এ খাতে সংশ্লিষ্ট ৮৩ শতাংশ কর্মী।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ অধিশাখা-২ থেকে বিধিমালাটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ই-বর্জ্য মজুদ করার জন্য অবশ্যই পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মজুদ করার স্থানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। মজুদকালীন বা তার আগে-পরে ই-বর্জ্য যেন কোনোভাবেই মাটি-পানি ও বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায় এজন্য সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিবেশগত সংকট কাটাতে ই-বর্জ্য বিধিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সাধারণ বর্জ্যের চেয়ে ই-বর্জ্য পরিবেশের জন্য বেশি ক্ষতিকর। ই-বর্জ্য সাধারণত লোহা, তামা বা কঠিন ধাতব পদার্থ দিয়ে গঠিত। এসবে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সিসা, ফাইবার গ্লাস, কার্বন, সিলিকন, পারদ, লিথিয়াম ইত্যাদি উপাদান থাকে, যা মাটি, পানি ও বায়ুর সঙ্গে মিশে পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকির মুখে ফেলে দেয়। পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব এমন বর্জ্য রেখে বাকিগুলো বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
পুরনো বা ব্যবহূত ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করে বিধিমালার ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, কোনো পুরনো বা ব্যবহূত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করা অথবা দান, অনুদান বা অন্য কোনোভাবে গ্রহণ করা যাবে না। তবে গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য অধিদপ্তরের অনাপত্তি সাপেক্ষে গ্রহণ করার বিধান রাখা হয়েছে। আর দেশে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকলে ই-বর্জ্য রফতানির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে বিধিমালার ১৯ নম্বর ধারায়।
ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারকের সংজ্ঞা হিসেবে বিধিমালায় বলা হয়েছে, নিজস্ব ব্র্যান্ডের অধীন ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন, বিক্রয়, মজুদ ও বিপণন করে থাকে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর আওতায় পড়বে।
বিধিমালা অনুযায়ী, প্রস্তুতকারক ব্যক্তি কেবল ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার উপযোগী বা ধ্বংস করার জন্যই সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রত্যেক মজুদকারী বা ব্যবসায়ী নিরাপত্তার সঙ্গে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে নিরাপদ পরিবহনের মাধ্যমে সংগ্রহ কেন্দ্রে পাঠাবেন। মেরামতকারীও মেরামত প্রক্রিয়ায় উত্পন্ন ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে মেরামত কেন্দ্রে পাঠাবেন। সংগ্রহ কেন্দ্র অবশ্যই পরিবেশসম্মত উপায়ে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করবেন। ব্যক্তিগত ভোক্তা ই-বর্জ্য সংগ্রহকারীর কাছে জমা দেবেন। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য পরিবহন করা বাধ্যতামূলক।
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য চূর্ণ করার বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে বিধিমালায়। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য সংরক্ষণ, মজুদ ও পরিবহন করতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এমন কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে বিপজ্জনক পদার্থের মানমাত্রা বজায় রাখার বিষয়েও নির্দেশনা রয়েছে বিধিমালায়। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সব তথ্য সংরক্ষণ ও প্রতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠানোর বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ২০ অনুযায়ী এসব বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব বিধির কোনো একটি লঙ্ঘন হলে পরিবেশ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ১৫ অনুযায়ী প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য হবে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে দুই থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রদান করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন) মির্জা শওকত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোই এখন আমাদের প্রথম কাজ। প্রাথমিকভাবে আমরা পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার জন্য প্রস্তুতকারকদের বাধ্য করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।
