বিশ্ব

গোঁড়া অর্থশাস্ত্রবিদদের নীতি চিন্তা বিষয়ে সতর্কতা

ড্যানি রডরিক

নব্য উদারবাদের মৃত্যু ঘটেছে। অথবা এমনও হতে পারে, নব্য উদারবাদ আসলে খুব ভালোভাবেই চলমান রয়েছে। পণ্ডিতরা নব্য উদারবাদকে দুদিক থেকেই ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু যেদিক থেকেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, অর্থশাস্ত্রের নীতিনির্ধারণী জগতে নতুন অগ্রসরমাণ কিছু ঘটতে চলেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তিনটি খাতে বিপুল সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। সেগুলো হলো: () নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয়, () বিপুল পরিমাণে অবকাঠামো নির্মাণ এবং () পরিবেশবান্ধব সবুজ অর্থনীতিতে রূপান্তরের কার্যক্রম গ্রহণ। বাইডেন সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাটি কাজে লাগিয়ে দেশের ভেতরের দুটি ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করেছেন: () অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা এবং () ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানার উৎপাদনের প্রক্রিয়াযেটি আশির দশক থেকে অধিকাংশই অন্য দেশগুলোয় চলে গিয়েছিল উৎপাদন খরচ সাশ্রয় সস্তা শ্রম ব্যবহারের জন্যসেগুলোকে দেশে ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বাইডেনের ট্রেজারি সচিব জেনেট ইয়েলেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর করপোরেট করহার বৈশ্বিকভাবে সমন্বিত করার কাজ করে চলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান কর্তাব্যক্তির সাধারণত দায়িত্ব থাকে সরকারের অঙ্গ হিসেবে পণ্যের বাজারদর স্থিতিশীল রাখার জন্য কাজ করা; কিন্তু বর্তমান প্রধান জেরেমি পাওয়েল মূল্যস্ফীতির ভিত্তিকে দমিয়ে রাখতে আর্থিক ব্যবস্থার সম্প্রসারণে সরকারকে সাহায্য করছেন।

ওয়াশিংটনের গৃহীত এসব নীতিনির্ধারণী পরিবর্তনে এটি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে যে প্রচলিত জ্ঞানগরিমা থেকে এগুলো পরিষ্কারভাবে আলাদা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসবের ভালো কিংবা মন্দ যে ফলই আসুক না কেন, তারা কি অর্থশাস্ত্রে নতুন চিন্তার পরিসর উন্মুক্ত করতে পেরেছেন?

যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা আরো বৃহৎ পরিসরে পুরো পশ্চিমা বিশ্বেরই আর্থিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন দীর্ঘদিন ধরে অনুভূত হচ্ছিল। সংস্কারের ধারণা বেশ বড়সড় আকার পায় ১৯৮০-এর দশকের গোড়া থেকেইযখন ওয়াশিংটন কনসেন্সাস, বাজারপন্থী গোঁড়া ভাবনা (মার্কেট ফান্ডামেন্টালিজম) অথবা নব্য উদারবাদ শক্তিমান হয়ে উঠছিল। কারণ কেইনসবাদ এবং সরকারি বিধিনিষেধের নিয়ন্ত্রণকে তখন ব্যর্থ মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ থেকে বাজার মুক্ত করতে গিয়ে তারা বাজারের প্রাণই সংহার করল। তারা এমন কতগুলো উচ্চমাত্রার ফাটকা পুঁজিভিত্তিক সম্পদ সৃষ্টি করল, যেগুলো অসম অস্থিতিশীল অর্থনীতির জন্ম দিল। অর্থনীতি আজকের পৃথিবীর অত্যন্ত গুরুতর সংকটগুলোকে মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম। গভীরতর সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট, সামাজিক অন্তর্ভুক্তির সমস্যা এবং ধ্বংসাত্মক নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার।

বিদ্যমান নীতি পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে আমরা যে পদ্ধতিতে অর্থশাস্ত্র পড়াই সেখান থেকে। অর্থশাস্ত্রবিদদের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য বাজারের ক্ষমতায় মুগ্ধ হওয়ার ঝোঁক থাকে। অ্যাডাম স্মিথ প্রণীত অদৃশ্য হস্ত ধারণাটিই অর্থশাস্ত্রবিদের মাথার মুকুট। স্মিথের অদৃশ্য হস্ত ধারণাটি হলো, প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য আত্মস্বার্থে ক্রমাগত কাজ করে চললে সমাজে বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে যৌথ সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। ধারণা গভীরভাবে কাণ্ডজ্ঞানবিরোধী। অর্থনীতিবিদরা কেন অসংযতভাবে এত পরিমাণ সময় বাজার-কেরামতি দর্শনে অন্ধভাবে ব্যয় করেন, তার কারণ সম্ভবত স্মিথের অদৃশ্য হস্তের ধারণা।

বিদ্যাচর্চার বিষয় হিসেবে অর্থশাস্ত্র কিন্তু বাজারের এত গুণকীর্তন করে না। প্রকৃতপক্ষে অর্থশাস্ত্রের অনেক শাখাই বাজার কীভাবে বেশি পরিমাণ বৈষম্য সৃষ্টি করে, তার বিশ্লেষণে মনোযোগ দেয় এবং কীভাবে বাজার নিজের ঘোষিত নিয়মেই সম্পদ (রিসোর্সেস) বরাদ্দে কুশলতায় ব্যর্থ হয়। পূর্ণাঙ্গ প্রতিযোগিতাময় (পারফেক্টলি কম্পিটিটিভ) বাজার ব্যবস্থায় বাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈরিতামুক্ত সমস্থিতি (ইকুলিব্রিয়া) সৃষ্টি করবেএমনটি ঘটতে পারা অনেক সম্ভাবনার মধ্যে একটিমাত্র সম্ভাবনা। স্মিথীয় মডেলটি একমাত্র মডেল নয়, কিন্তু তবুও অবাধ বাণিজ্যনীতি (লেঁসে-ফেয়ার) থেকে প্রস্থানের কথা উঠলে অনেক অর্থশাস্ত্রবিদই কেঁপে উঠে বলবেন যে বাজারের ভেতর দক্ষ করণভবন (ওয়েল ফাংশনিং) প্রতিযোগিতার সুন্দর পরিবেশ থাকলে তাকেই তারা আদর্শ অবস্থা মানেন।

সৌভাগ্যবশত অর্থশাস্ত্র শিক্ষায় নতুন চিন্তার অস্তিত্ব আছে। কোর প্রজেক্ট হলো বিনা মূল্যে অনলাইনভিত্তিক শেখার প্লাটফর্ম যেখানে পাঠ্যবইগুলো পড়ার অবাধ সুযোগ রয়েছে। কোরের প্রতিষ্ঠার পেছনে সময়ের দুজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। প্রথমজন হলেন শান্তা ফে ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক স্যামুয়েল বাওলেস এবং দ্বিতীয়জন হলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ওয়েন্ডি কার্লিন। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী বড়সংখ্যক অর্থনীতিবিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি গড়ে তোলা হয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ কোর ব্যবহার করছে।

কোরের শিক্ষণ পদ্ধতির একটি সুবিধা হলো এটি অসাম্য জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাকে সরাসরি আলোচনার মধ্যে আনে। অর্থশাস্ত্রের শিক্ষাতত্ত্বে (পেডাগোজি) পরিবর্তন বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। কারণ শাস্ত্রের গতানুগতিক ধারার মাপকাঠির পরিবর্তে বিকল্প মাপকাঠিতে বিচার করা হয়, যেগুলো বাস্তবসম্মত কার্যকর ফল দেয়। যেমন প্রচলিত অর্থশাস্ত্র পাঠের অনুমানগুলোর বিপরীতে কোরের পাঠ পদ্ধতি অনুমান (অ্যাজাম্পশন) করে যে সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিরা আত্মস্বার্থ রক্ষার বদলে সমষ্টি বা সমাজের স্বার্থ রক্ষাকারী (প্রো-সোস্যাল) এবং তারা দূরদৃষ্টি ধারণের পরিবর্তে অদূরদর্শী। প্রচলিত ধারার সঙ্গে কোরের চিন্তাধারার আরো পার্থক্য আছে। প্রতিযোগিতার পরিপূর্ণ পরিবেশ (পারফেক্ট কম্পিটিশন) বজায় আছে গতানুগতিক অর্থশাস্ত্রের এমন অনুমানের চেয়ে কোরের ভাবনা হলো প্রতিযোগিতার পরিবেশটি হলো অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ, যেখানে শুধু বিজয়ীরা পুরোটা অংশই নিয়ে যায়। ঋণবাজার শ্রমবাজারে ঋণদাতা বা নিয়োগকর্তার সঙ্গে ঋণগ্রহীতা বা নিয়োগপ্রাপ্তের মধ্যে (অসম) ক্ষমতা সম্পর্ক সবসময়ই বিদ্যমানএকে ফেনানো (ডিফিউজ) বিষয় বা বহিঃস্থ কারণ (এক্সোজেনাস) হিসেবে বিবেচনা করে না কোর। মূলধারার অর্থশাস্ত্রে সম্পত্তির (বাড়ি বা জমি) খাজনা বা ভাড়া (রেন্ট) বিষয়টিকে নীতি প্রণয়নের ত্রুটি কিংবা কদাচিৎ ঘটনা হিসেবে দেখা হলেও কোরের চিন্তায় সে রকমটি মনে করা হয় না।

অর্থশাস্ত্র পঠনে অর্থনীতির নীতিনির্ধারণে ধরনের নতুন চিন্তা সমাজের ফলাফল অধিকতর ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করবে। কিন্তু আমাদের এও মেনে নিতে হবে যে অর্থনীতির নীতিনির্ধারণে এটি নতুন চিন্তার উদ্বোধন ঘটাবে না এবং এটিই হওয়ার কথা, অন্য কিছু নয়।

অর্থশাস্ত্রে আগের সব নীতিনির্ধারণী চিন্তাধারায় সেটি মার্কেন্টালিস্ট, ধ্রুপদী উদারপন্থী, কেইনসীয়, সামাজিক-গণতন্ত্রী, রাষ্ট্রভিত্তিক উদারবাদ (অরডোলিবারালিজম) কিংবা নব্য উদারবাদী ধারাএসব চিন্তাধারায় বাস্তবতা বোঝার ক্ষেত্রে বেশ গুরুতর অসংবেদনশীল অংশ রয়েছে। কারণ উল্লিখিত প্রত্যেক চিন্তার ঘরানাগুলোই দুনিয়াব্যাপী সবসময়ের জন্য নিজেদের সর্বজনীন প্রকল্প হিসেবে বিশ্বাস করে আসছে। এর ফল অনিবার্যভাবে প্রত্যেক চিন্তার ঘরানার উদ্ভাবনের কৃতীগুলো তাদের নিজস্ব অসংবেদনশীল অংশের কারণে ঢাকা পড়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সুশাসনের দিকটি ওপরের ঘরানাগুলোর কৃতিত্বকে ম্লান করে দিয়েছে। এর ফল দাঁড়িয়েছে অনেকটা পেন্ডুলামের দোদুল্যমান বলটি যেমন দুদিকেই টাল খায়, ঠিক সে রকম। সরকারের ভূমিকা একদিকে অতিরিক্ত ইতিবাচকতা এবং অন্যদিকে নেতিবাচকতার দুইয়ের মধ্যে দুলছে।

অর্থশাস্ত্রে নীতিনির্ধারণী প্রশ্নটি ইতিবাচকতা কিংবা নেতিবাচকতার কোনো পক্ষের দিকে ঝুঁকবে, তার সঠিক উত্তর হবে—‘এটি অন্য অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করবে। অর্থনীতির বিশ্লেষণ তথ্য-প্রমাণের ওপর আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফল নির্ভরশীল। সত্যি সত্যিই কার্যকর অর্থশাস্ত্রের প্রধান শব্দগুচ্ছ হলো আকস্মিক বা অনির্ধারিত ব্যয়ের তহবিল (কনটিনজেন্সি), প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট (কনটেক্সচুয়ালিটি) অসর্বজনীনতা (নন-ইউনিভার্সালিটি) অর্থশাস্ত্র আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে কোন কোন সময়ে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে আবার কখনো কখনো সরকারি ব্যয় সংকোচন করার সময় আসে। এমন সময় আসে যখন সরবরাহ ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে। আবার এমন সময়ও উপস্থিত হয় যখন সরবরাহ ব্যবস্থা বাজার এর সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার ওপর ছেড়ে দিতে হয়। কখনো কর বাড়াতে হয় আবার কখনো কর কমিয়ে দিতে হয়। কিছু অঞ্চলে বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দিতে হয় আবার কিছু স্থানে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হয়। আমাদের চাহিদামতো বিভিন্ন ধরনের নীতিগত পরিবর্তন বাস্তবায়ন বাস্তব দুনিয়ার বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যে সংযুক্তির চিত্র আঁকতে ভালো অর্থশাস্ত্র আমাদের নির্দেশনা দেয়।

আমাদের সমাজগুলো অনেক মৌলিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, যেগুলো মোকাবেলা করতে হলে অর্থশাস্ত্রের নতুন জ্ঞান বড় ধরনের নীতিনির্ধারণী পরীক্ষণের প্রয়োজন। বাইডেন প্রশাসন দেশের অর্থনীতির রূপান্তরে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ছিল বহুল প্রত্যাশিত কাজ। কিন্তু বাইডেনের সিদ্ধান্তের ভেতর যারা অর্থশাস্ত্র চিন্তার নতুন পরিসর অনুসন্ধান করছেন, তাদের সদিচ্ছার ব্যাপারে আরো কিছুটা সাবধানী হওয়া জরুরি। ইতিহাসে প্রগতিবিমুখ পরবর্তী গোঁড়া চিন্তা কাঠামো বিনির্মাণ করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। অধিকন্তু, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা যেন সেগুলো পৃথিবীর জরুরি পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়; অর্থশাস্ত্রের কাঠামো আমাদের তা শিখতে সহায়তা করবে।

 

[স্বত্ব:
প্রজেক্টসিন্ডিকেট
]                   

 

ড্যানি রডরিক: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগের ফোর্ড ফাউন্ডেশন অধ্যাপক। স্ট্রেইট টক অন ট্রেড: আইডিয়াস ফর অ্যা সেইন ওয়ার্ল্ড ইকোনমি বইয়ের লেখক

ভাষান্তর: আহমেদ জাভেদ, সভাপতি প্রতিষ্ঠাতা, বাংলার পাঠশালা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন