স্থবির ক্যাম্পাসেও ব্যয় বাড়ছে সরকারের

ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুক ইউজিসি

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের কাছ থেকে দুই ধরনের বাজেট বরাদ্দ পায়। একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রতি বছরের ব্যয় এবং আরেকটি হচ্ছে উন্নয়ন বাজেট, যেটি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ব্যয় বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার বরাদ্দের বড় অংশই ব্যয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুন্নয়ন খাতেবেতন-ভাতা পরিশোধে। গবেষণায় বরাদ্দ এখনো নামমাত্র। করোনার মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ নেই বললে চলে, এমনকি কোনো পরিকল্পনাও নেই তাদের। করোনার সময়ে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় পরিবহন, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য ব্যয় কমে আসার কথা থাকলেও চাহিদাপত্রে তার কোনো প্রতিফলন নেই। এসব অসংগতির মধ্যে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যে উদ্দেশ্যে অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে, সেটি যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে নজর দেয়া দরকার।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাজেট বৃদ্ধি পেলেও টাকা খরচের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নানা অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আন্দোলনও করেছেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা যথাযথভাবে খরচ করা হয় না এবং তার কোনো হিসাবও দেয়া হয় না। সন্দেহ নেই, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম হচ্ছে, সেটা দূর করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়ানো যেত। সবাই আশা করে, বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিক খাতে ব্যয় হবে, কোনো নয়ছয় হবে না, অপচয় হবে না। কিন্তু সবসময় সব বিশ্ববিদ্যালয় কাজটি সঠিকভাবে করে, সেটি কিন্তু নয়। জবাবদিহিতা এখন পর্যন্ত খুব বেশি নিশ্চিত করা গেছে, সেটিও দৃশ্যমান নয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনের চেক-সংক্রান্ত বিষয়ে অনিয়ম থাকার কারণে অডিট আপত্তি উঠেছিল। তখন তাদের বেতনের চেক আটকে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বরাদ্দ টাকা সে খাতে খরচ না করে কিছু শিক্ষক সেটি ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা গেছে, তা- বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে জাতিকে পথ দেখাবে, সেখানে এমন দুর্নীতি অনিয়ম কাম্য নয়। এটি বন্ধে ইউজিসির তদারকি কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে নিয়মিত আর্থিক নিরীক্ষা করা উচিত। দায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে হবে। আর এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা জরুরি। সব ছাপিয়ে হতাশার বিষয় হলো, ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হলেও গবেষণায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়প্রতি গবেষণা বরাদ্দ মাত্র কোটি টাকার কিছু বেশি। এত কম অর্থ দিয়ে ব্যাপক আকারে মানসম্পন্ন গবেষণা যে সম্ভব নয়, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিশ্বের খ্যাতনামা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সালে গবেষণা খাতে ১১৭ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। হার্ভার্ডের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয় বছরে ১০০ কোটি ডলার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি) খাতে খরচ করে। করোনা ভ্যাকসিনের মতো বড় বড় উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়। মহামারী করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে তারা টিকা এনেছে। বৈশ্বিক নানা সংকট সমস্যার সমাধানে যখন নেতৃত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার অবস্থা খুবই নাজুক। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা হচ্ছে শুধু উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া কিংবা শিক্ষার প্রয়োজনে। এসব গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই জাতীয় উন্নয়নে খুব একটা অবদান রাখছে না। জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা উৎসাহিত করার জন্য কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান না থাকা, গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দেয়া, যা বরাদ্দ আছে তারও যথাযথ ব্যবহার না হওয়া, তদারকির ঘাটতিসহ নানা কারণে দেশে গবেষণার খরা চলছে। এমন প্রবণতা বন্ধে গবেষণাকে আরো উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি প্রমোশনের সঙ্গে গবেষণাকে যুক্ত করে দেয়া এখন সময়ের দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধির পেছনে যুক্তি হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, প্রতি বছরই শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যয় বাড়ে। তাছাড়া আসবাবসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে। করোনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য খাতেও ব্যয় বাড়তে পারে। করোনার মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অ্যাডহক মাস্টাররোলে নিয়োগ বন্ধ ছিল না। নতুন করে শিক্ষক কর্মকর্তাও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনেক শিক্ষককে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আবার অনেক শিক্ষককে আপার গ্রেডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিষয়টি অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়লেও গবেষণা বাবদ বরাদ্দ কিন্তু সঠিকভাবে ব্যয় করতে পারেনি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকে প্রতীয়মান হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেয়ায় যে পরিমাণ সক্রিয়, ঠিক ততটাই উদাসীন গবেষণা পাঠদানে। কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়ছে. এমনকি আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্পন্ন স্থান করে নিতে পারছে না। 

করোনার মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হতো যদি এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতো। কিন্তু আমরা দেখছি ১৫ মাসের অধিক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ। সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কোনো প্রচেষ্টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে লক্ষ করা যায়নি, পরীক্ষাও নেয়া হয়নি। বরং অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে অনেককে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ডিজিটাল নাম ধারণকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাকি অনলাইনে পরীক্ষা নিতে উৎসাহী নয়! এমনকি অনলাইনে শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগও করেনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। -সংক্রান্ত তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও বাজেটের চাহিদাপত্রে ফুটে ওঠেনি। তারা গতানুগতিক বেতন-ভাতা ভবন নির্মাণেই বেশি আগ্রহী। অথচ বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বরাদ্দের একটি অংশ ব্যয় করেছে। তারা বিশ্বের আধুনিক সব ব্যবস্থা দ্রুততার সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য নিশ্চিত করেছে। শুধু তা- নয়, কঠোর তদারকিও জারি রেখেছে যাতে কোনো শিক্ষক ফাঁকি দিতে না পারেন। প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে, সেজন্য তারা উদ্যোগ নিয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ দূরে থাক, করোনার প্রাদুর্ভাব বজায় থাকলে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কীভাবে এগিয়ে নেয়া হবে, তার কোনো রূপকল্প কেউ হাজির করেনি। এমন প্রবণতা উচ্চশিক্ষার জন্য মোটেই সহায়ক নয়। আমরা চাইব, অনলাইনের মাধ্যমে পাঠদান পরীক্ষা, গবেষণা প্রভৃতি নিশ্চিতকরণে বিনিয়োগ বাড়ানো হোক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন