লি কেকিয়াংকে ইমরান খানের চিঠি

‘এখন পারব না এক বছর সময় দিন’

বণিক বার্তা ডেস্ক

চীনের কাছ থেকে গত বছর ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছিল পাকিস্তান। ঋণ পরিশোধের সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী সপ্তাহেই। এরই মধ্যে অর্থ পরিশোধের জন্য আরো এক বছর সময় চেয়েছে ঋণ জর্জরিত ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত সপ্তাহেই বিষয়টি নিয়ে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার পোস্টের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, গত সপ্তাহে লি কেকিয়াংকে চিঠি পাঠান ইমরান খান। ওই চিঠিতে বলা হয়, চীনের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ পাকিস্তানের বহিঃঋণের চাপ সহজ করে আনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ঋণের অর্থ পরিশোধের জন্য দেশটির আরো এক বছর সময় দরকার।

চিঠিতে ঋণ পরিশোধের জন্য ১২ মাস সময় চাওয়ার পাশাপাশি শতাংশ হারে সুদ পরিশোধেরও প্রস্তাব দিয়েছেন ইমরান খান।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, ঋণচাপে জর্জরিত পাকিস্তানের অবস্থা এখন দেউলিয়া প্রায়। ঋণের বড় একটি অংশ এসেছে চীনের কাছ থেকে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ হিসেবে। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) পরিকল্পনার আওতায় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলেছে পাকিস্তান। বেইজিংয়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন পাকিস্তানের গোটা অর্থনীতির জন্যই গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।

আগেও চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছে পাকিস্তান। চলতি বছরেই ৩০০ কোটি ডলারের একটি ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বেইজিংয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছিল ইসলামাবাদ। সিপিইসি পরিকল্পনার অধীনে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঋণ নিয়েছিল ইসলামাবাদ।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত চীন আবেদন নাকচ করে দিলে মারাত্মক এক ঋণ সংকটে পতিত হয় পাকিস্তান। ওই সময়ে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুনর্গঠন করতে হলে চীনা ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণের শর্ত সংশোধন করতে হবে। অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো এর জন্য প্রস্তুত নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের বৈদেশিক পরিস্থিতি এরই মধ্যে বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের শেষ নাগাদ দেশটির সরকারের মোট দায়দেনার পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে। মোট ঋণ দায়ের অংক পাকিস্তানের মোট জিডিপির ১০৯ শতাংশের সমান।

সেখান থেকে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এসবিপি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চের শেষেও দেশটির মোট ঋণ বহির্দায়ের পরিমাণ ছিল ৪৫ লাখ ৪৭০ হাজার কোটি পাকিস্তানি রুপি (২৯ হাজার কোটি ডলারের বেশি) পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় লাখ ৬৭ হাজার কোটি পাকিস্তানি রুপি বা দশমিক শতাংশ বেশি।

চীনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছেও অনেক দেনা রয়েছে পাকিস্তানের। এর পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। গত বছরের মার্চে আইএমএফের কাছে ইসলামাবাদের মোট দেনার পরিমাণ ছিল লাখ হাজার কোটি পাকিস্তানি রুপি। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে লাখ ১৬ হাজার কোটি পাকিস্তানি রুপিতে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, মূলত চীনা ঋণের টাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে পাকিস্তান। বিশেষ করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই দেশটিকে ঋণের মারাত্মক এক দুষ্টচক্রে জড়িয়ে ফেলেছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশটির অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে পারেনি। উল্টো সরকারি ব্যয় বাড়িয়েছে।

এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ পাকিস্তান সরকার। একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও দেশটির সঞ্চালন ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ফলে দেশটির গ্রাহকদেরও খুব একটা উপকার হচ্ছে না। এর পরও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চমূল্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে ইসলামাবাদকে। এছাড়া ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়েছে।

পাকিস্তানি অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের তুলে ধরা পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালেও পাকিস্তানের বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭২০ কোটি ডলার। চলতি বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার ৫৮০ কোটি ডলারে। চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চার বছরের মধ্যে তা গিয়ে ঠেকবে হাজার ৬৩০ কোটি ডলারে। অন্যদিকে ইসলামাবাদকে প্রতি বছর শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবেই পরিশোধ করতে হচ্ছে ৫৯০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। কয়েক বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৯৮০ কোটি ডলারে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে পাকিস্তানের মোট ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির জিডিপির ১১ শতাংশে।

অবস্থায় পাকিস্তানও চাচ্ছে না দেশটিতে নতুন করে আর কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হোক। কিন্তু সিপিইসি পরিকল্পনার আওতায় আরো কিছু নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ ইসলামাবাদ। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র পাকিস্তানের জন্য সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছে ইসলামাবাদ। এজন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা কয়েকবার চীন সফর করেছেন। ঋণ পুনর্গঠনের পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপনের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তির বিষয়ে বারবার দেনদরবার করেছেন তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন