পর্যালোচনা

প্রস্তাবিত বাজেট ঘিরে কিছু প্রস্তাব

জাফরুল্লাহ চৌধুরী

বাজেটে কিছু ভালো সিদ্ধান্ত

. লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে, বাড়ির নকশা অনুমোদন করতে, সমবায় সমিতি নিবন্ধনে এবং ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য, মোটরসাইকেল, গাড়ি, জায়গাজমি, ফ্ল্যাট কিনতে হলে অবশ্যই ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) দেখাতে হবে। আরো নিয়ম করা প্রয়োজন যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির টিআইএন থাকতে হবে, এমনকি আয়করযোগ্য আয় না থাকলেও কিংবা বেকার হলেও। এজন্য বছরে মাত্র ২০০ টাকা টিআইএন রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে। গৃহকর্মীদের, রিকশা-ভ্যানচালক, বেবিট্যাক্সি, মোটরগাড়িচালকদের টিআইএনের জন্য বছরে ২০০ টাকা ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেবেন বাড়ির কর্ত্রী গাড়িমালিকরা। কৃষি শ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশন করাবেন জমির মালিকরা। এতে প্রায় নতুন দুই কোটি লোক আয়কর নিবন্ধনের আওতায় আসবে, যারা আগামী পাঁচ বছরে ইনকাম ট্যাক্স দেয়ার উপযুক্ততা অর্জন করবে। ন্যূনতম ফি বাবদ বছরে আয় হবে ৪০০ কোটি টাকা। ভবিষ্যতে বেকার ভাতা প্রচলন করলে পদ্ধতি সুফল দেবে। . দেশে বর্তমানে টিআইএন আছে ৬১ লাখ। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দেন ২৫ দশমিক ৪৩ লাখ মাত্র। বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, কিন্তু মনোবৃত্তির পরিবর্তন হয়নি। জনগণের আয় বেড়েছে, কিন্তু রাজস্ব কর্মকর্তাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ফলে হয়রানি, তদবির দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারে জনগণ আয়করের জন্য নিবন্ধিত হতে চায় না। ব্যক্তিগত আয় লাখ টাকার পরিবর্তে লাখ টাকা অবধি শূন্য আয়করের আওতায় আনা যুক্তিসংগত হবে এবং ব্যক্তিগত আয়কর ২০ শতাংশের অধিক হওয়া উচিত নয়। . অর্থমন্ত্রী ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগকারী নারীদের ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্ত করে ভালো প্রণোদনা দিয়েছেন। মধ্যবিত্তের গৃহস্থালি বসবাসে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি উৎপাদনকে ১০ বছর ট্যাক্স হলিডে দিয়ে স্বচ্ছ চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। . তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের চাকরি দিলে কর রেয়াত প্রদান একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে ১০০ জনের সীমা নামিয়ে ১০ জনে সীমিত করুন।

শুল্ক করসংক্রান্ত পদক্ষেপ কিছু প্রস্তাব

. সব মেডিকেল যন্ত্রপাতি সামগ্রীর (অ্যানালাইজার, ক্যাথল্যাব, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ডিফিবরিলেটর, ভেন্টিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর, সিটি অ্যাপারাটাস হাসপাতাল শয্যা: ব্লাড ব্যাংক, সিরিঞ্জ পাম্প, সার্জিক্যাল স্টেরাইল গ্লাভস, বায়োসেফটি কেবিনেট প্রভৃতি) ওপর সব প্রকার শুল্ক, অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স এজেন্সি ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নিন। সব আমদানি থেকে অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স প্রত্যাহারের জন্য ব্যবসায়ীদের দাবিও বিবেচ্য। . হেমোডায়ালাইসিসের প্রত্যেক রোগীর জন্য একটি ব্লাড টিউবিং ব্যবহার করতে হয়, তার ট্যাক্স ছিল ২৫ শতাংশ তা কমিয়ে শতাংশ করেছেন, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কারো বিকল কিডনির সমস্যা হলে ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে রোগী সর্বস্বান্ত হয়ে যায় তিন বছরের মাথায়। এজন্য সব দরিদ্র বিকল কিডনি রোগীকে প্রতি হেমোডায়ালাইসিসের জন্য হাজার টাকা ভর্তুকি দেয়া উচিত। . বিকল কিডনির সর্বোত্তম চিকিৎসা হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। দেশে প্রয়োজন প্রতি বছর ১০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন, কিন্তু দেশে প্রতিস্থাপন হয় ২০০-এর অনধিক। বেশির ভাগ রোগী একজনকে সঙ্গে নিয়ে যায় ভারত, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকায়। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিদেশে ব্যয় হয়। এজন্য মূলত দায়ী স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়। তারা গত দুই বছরে হাইকোর্টের নির্দেশ পালন করছে না। হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন যে নিকটাত্মীয় ছাড়াও অনাত্মীয় ব্যক্তি বা বন্ধুর জন্য যে কেউ স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে পারবেন। . ফোয়ারার যন্ত্রপাতির ট্যাক্স শতাংশ থেকে কমিয়ে শতাংশ করে ভুল করেছেন, প্রকৃতপক্ষে এটা নিদেনপক্ষে ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। আরো ভাওল িকাজ করেছেন স্থানীয়ভাবে ওষুধ শিল্পের প্রায় সব কাঁচামালের রেয়াতি সুবিধা দিয়েছেন। দেশে এপিআই উৎপাদন হলে সব ওষুধ কোম্পানিকে স্থানীয় কোম্পানি থেকে কাঁচামাল কেনা বাধ্যতামূলক করুন। আমদানি করা যাবে না। তদুপরি প্রত্যেক এপিআই কোম্পানিকে রফতানির জন্য আগামী পাঁচ বছর ২৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন, বিশেষত ভারত চীনের উৎপাদক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য অর্জনের জন্য। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯২টি দেশে ওষুধের কাঁচামাল রফতানির যে তথ্য দিয়েছেন তা সঠিক নয়। বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করে, ওষুধের কাঁচামাল রফতানি করে না। . মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ক্যান্সার হূদরোগের কতক ওষুধে রেয়াতি সুবিধা দিয়েছেন, এতে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা লাভবান হবেন, কিন্তু ওষুধের দাম কমবে না। ফলে সরকারের সদুদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ওষুধের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হলে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির অধ্যাদেশের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়মাবলি যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে ১১৭টি ওষুধ, ভ্যাকসিন, পরিবার পরিকল্পনাসামগ্রী ছাড়া অন্য সব ওষুধের মূল্য ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো নিজেরা সরাসরি স্থির করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানিয়ে দেয়। ঔষধ প্রশাসন কেবল মূসক (ভ্যাট) যুক্ত করে ওষুধের মূল্য ঘোষণা করে। পদ্ধতি মূল্য নির্দেশক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে ওষুধের খুচরা মূল্য ন্যূনতম পক্ষে ৫০ শতাংশ কমে আসবে। . আপনার অন্য ভালো কাজ হলো জনগণের পুষ্টিবৃদ্ধির জন্য সব পোলট্রি, ডেইরি ফিশ ফিডের প্রয়োজনীয় উপকরগুলোকে রেয়াতি সুবিধা দিয়েছেন। . বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহূত অনেকগুলো কাঁচামালের শুল্ক কমিয়েছেন এসআরও ১১৪/২০২১-এর মাধ্যমে। এখানে একটি বড় ভুল করেছেন, কয়েক ক্ষেত্রে শূন্য শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শতাংশ, কয়েক ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করেছেন, এতে দুর্নীতি হবে। তিনটির (শূন্য, ১৫ শতাংশ) পরিবর্তে একটি শুল্কদর স্থির করে দিন।

. সব আমদানীকৃত খাদ্য বিকারক চিনিযুক্ত কনফেকশনারী, সাবান বাদে এক শুল্কদর করে দিন। আপনি স্থির করেছেন সাবানের শুল্ক ২৫ শতাংশ কনফেকশনারিতে ৬০ শতাংশ। সুগন্ধি সাবান, বিদেশী কনফেকশনারি শুল্ক সম্পূরক সমেত ২০০ শতাংশ করুন। এগুলো দেশে তৈরি হয়, আমদানি অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা মাত্র। . ২০০ শতাংশ শুল্ক সম্পূরক কর প্রয়োগ হওয়া উচিত আমদানীকৃত টাইলস, মার্বেল বিদেশী মদ এবং সিগারেটের ওপর। মদের ওপর মাত্র ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি কোনোক্রমে গ্রহণযোগ্য নয়। আরো বাড়াতে হবে। ১০. ওষুধ অন্যান্য সামগ্রীর রেগুলেটরি ডিউটি ১০, ১৫ ২৫ শতাংশের পরিবর্তে সব ক্ষেত্রে একটি দর হওয়া উচিত। এতে হয়রানি দুর্নীতি কমবে। ১১. মোপেড অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করে মধ্যবিত্তদের খুশি করেছেন। তবে এসব ক্ষেত্রে একাধিক শুল্কের পরিবর্তে সব ক্ষেত্রে ২০ বা ২৫ শতাংশ একক দর স্থির করুন। সব প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতিযুক্ত ২০০০/৩৫০০ সিসির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ স্থির করুন। ১২. শিল্পের কাঁচামালের একাধিক রেয়াতি শুল্ক শূন্য, , ১০ ১৫ শতাংশ প্রভৃতি থাকায় ব্যবসায়ীদের প্রতি কনসাইনমেন্ট খালাসের সময় হয়রানি, দুর্নীতি আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা অফিসারদের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দরাদরির সুযোগ থাকছে। সহজ সুরাহা হলো এক শুল্কদর করে দেয়া বা ১০ শতাংশ। ১৩. ফ্লোমিটারযুক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডারে সব প্রকার অগ্রিম আয়কর, শুল্ক সম্পূরক অন্যান্য সব করমুক্ত করে ব্যাপক আমদানির সুবিধা করে দিন। ১৪. বিদেশে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসকারী বাংলাদেশের পুত্র-কন্যারা পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রয় করে বিক্রয়লব্ধ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে স্থানান্তর করেন। অধিকাংশই সরকারকে ন্যূনতম একটা ট্যাক্স দিয়ে বৈধ পথে বিদেশে টাকা নিতে আগ্রহী কিন্তু, কোনো নিয়ম নেই। সম্পত্তি বিক্রয়লব্ধ অর্থ ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে বৈধ পথে বিদেশে নেয়ার ব্যবস্থা করে দিন। ১৫. অর্থমন্ত্রী বিড়ি-সিগারেট, মদ, গুলে ট্যাক্স না বাড়ানোয় এবং করপোরেট ট্যাক্স কমানোয় ব্যবসায়ীরা খুশি হয়েছেন। এনার্জি পানীয়তে ৫০ মদে ২০০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা ন্যায়সংগত হবে। সিগারেটের স্তর অনুসারে ১০ শালাকার মূল্য ৬০ থেকে ২০০ টাকা, বিড়ি ২৫ শলাকার মূল্য ৫০ টাকা স্থির করুন, সঙ্গে একই সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ। বাজার, লঞ্চঘাট, স্টেশন, পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত প্রাঙ্গণ এবং সব পাবলিক প্লেসে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন করতে হবে, ন্যূনতম জরিমানা হাজার টাকা অনাদায়ে সাতদিন জেল হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত অন্য সব পদে ধূমপায়ীদের নিয়োগ আইন করে রহিত করা বাঞ্ছনীয়।

কৃষকদের প্রতি নজর দিন

কালবৈশাখীতে ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ কৃষকের জন্য ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন। নিদেনপক্ষে পাঁচ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিন। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণ, কফি, কাজুবাদাম, হলুদ, আদা পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদ প্রণোদনা বাবদ ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দিন। দেশীয় উৎপাদন থেকে শিশুখাদ্য উৎপাদন কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী শিল্পকে ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব করেছেন। অথচ সরাসরি কৃষকের পানি সেচ, সার, বীজে পর্যাপ্ত ভর্তুকি, কৃষি উৎপাদন বাজারজাত করার জন্য সমবায় সৃষ্টি করে সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ নেই।

আরো কিছু সুপারিশ

. সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ হয়েছে আমলাদের জন্য জনপ্রশাসনে। জনপ্রশাসনে ন্যূনতম / অংশ বরাদ্দ কমান। গাড়ির জন্য মাসিক ব্যয় কোনোক্রমে ১০ হাজার টাকার অধিক নয়। সুশৃঙ্খল বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দ ন্যূনতম পক্ষে দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। . চেকের মাধ্যমে লেনদেন একটি আধুনিক পদক্ষেপ এবং দুর্নীতি নির্ণয়ে সহায়ক। হাজার টাকার বেশি সব লেনদেন চেক মারফত এবং সবার বেতন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। গণস্বাস্থ্য পদ্ধতি অনুসরণ করছে ১৯৭৩ সাল থেকে। এতে পথিমধ্যে রাহাজানি তহবিল তছরুপের সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। . প্রত্যেক প্রবাসী কর্মীর জন্য ৫০ লাখ টাকার জীবন বীমার ব্যবস্থা নিন। মারা গেলে বিনা খরচে শবদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা নিন। পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগে (১৭৯১ কোটি) বরাদ্দ কমিয়েছেন, যা কাম্য নয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

বেসরকারি শিক্ষা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ কর যোগ করে অর্থমন্ত্রী ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় -জাতীয় পার্থক্য অনৈতিক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির জন্য রেজিস্ট্রেশন ফির নামে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। প্রত্যেক বেসরকারি ডেন্টাল/ ফিজিওথেরাপির ছাত্রকে চার বছরে রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষার ফি বাবদ প্রায় ৮০ হাজার টাকা দিতে হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রাইভেট ক্লিনিক, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র, দন্ত এক্স-রে সেন্টার থেকে বার্ষিক রেজিস্ট্রেশনের নামে চাঁদা আদায় করে। একবারে পাঁচ বছরের জন্য রেজিস্ট্রেশন দিলে হয়রানি দুর্নীতি কমত। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সর্বাধুনিক পিসিআর কেন্দ্রের অনুমতি পেতে আট মাস লেগেছে। অথচ আমাদের একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের স্থলে চার ডক্টরেট একাধিক বছরের অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী রয়েছেন।

কভিড-পরবর্তী দরিদ্রতা নিরসন কর্মসংস্থান

. কভিড-পূর্ববর্তী ২০ শতাংশ দরিদ্রতা বেড়ে কভিডের কারণে ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এসব দরিদ্র পরিবারকে ছয় মাস ফ্রি রেশন দেয়া প্রয়োজন। মাসিক ১৫ কিলোগ্রাম চাল, ছয়-আট কিলোগ্রাম আটা, ১০ কিলোগ্রাম আলু, দুই কিলোগ্রাম ডাল, দুই লিটার তেল, এক কিলোগ্রাম চিনি, আধা কিলোগ্রাম লবণ, এক কিলোগ্রাম পেঁয়াজ, রসুন আদা, মরিচ প্রভৃতির মাসিক রেশনের জন্য খরচ হবে হাজার ২০০ টাকা। ছয় মাসে মোট ব্যয় হবে ৩০ হাজার কোটি টাকার অনধিক। . ৫০ হাজার রিকশা ভ্যানচালককে ২০ হাজার টাকা শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে ছয় মাসের মধ্যে রিকশা ভ্যানচালক রিকশা/ভ্যানের মালিককে চালকে পরিণত করার ব্যবস্থা নিন। -জাতীয় বিনিয়োগ -১২ মাসে ফেরত আসবে। . সব নাগরিকের জন্য করোনার ভ্যাকসিন নিশ্চিত করুন। ১৮ মাস আগে সিনোভ্যাক স্পুতনিক- ভ্যাকসিন আনার ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তখন গ্রহণ করলে প্রতি ডোজ - ডলারে পেতে পারতেন। এখন থেকে ২০ ডলার দিয়ে কিনতে হবে। দুই কোটি সোভিয়েত স্পুতনিক- টিকা পাওয়া যাবে ডলারে। টিকা মৃত্যু সংক্রমণ উভয় কমায় এবং কর্মদক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। তদুপরি স্বল্প সুদে সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করার নিমিত্তে বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকেও ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য সহায়তা পাওয়া যাবে।

দরিদ্রতা স্বাস্থ্য

দেশে প্রায় অরক্ষিত পাঁচ হাজার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, প্রায় ৪৫০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১৪ হাজার ৩৮৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং কয়েকশ জেলা, বিভাগ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে। কেবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কয়েকজন চিকিৎসকের উপস্থিতি দেখা যায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন চিকিৎসককে পাওয়া যায় না। ইউনিয়ন উপজেলা পর্যায়ে বসবাসকারী ৭০-৭৫ শতাংশ জনগণের ২০ শতাংশ রোগীর ভাগ্যে মৃত্যুর আগেও একজন এমবিবিএস চিকিৎসক দর্শনের সৌভাগ্য হয় না।

অর্থমন্ত্রী সব সরকারি মেডিকেল কলেজ ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যান্সার হাসপাতাল, সব জেলা হাসপাতালে নেফ্রোলজি ইউনিট কিডনি সেন্টার, ৩৩টি হাসপাতালে অটিজম নিউরো ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, ইউনিয়ন পর্যায়ে ১০ শয্যাবিশিষ্ট এমসিডবলিওসি মাতৃ শিশুসেবা কেন্দ্র পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর চট্টগ্রাম জেলার বাইরে অন্যান্য সব জেলায় ১০ বছরের কর অব্যাহতির ভিত্তিতে শিশু মাতৃস্বাস্থ্য, অনকোলজি (ক্যান্সার) প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের ২৫০ শয্যার সাধারণ হাসপাতাল এবং ন্যূনতম ২০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরির জন্য ১০ বছর আয়কর রহিত করছেন। কিন্তু এগুলো চালাবেন কারা?

সরকারি হাসপাতালে সব চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হলে কেবল বরাদ্দ বাড়ালে চলবে না, কতকগুলো মৌলিক পরিবর্তন কার্যকর করতে হবে। নিয়ম করতে হবে কোনো সরকারি চিকিৎসক কোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে কাজ করতে পারবেন না। সব অবকাঠামোর উন্নতি করতে হবে, হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রাচীর, গভীর নলকূপ, ইলেকট্রিক সাবস্টেশন, সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নার্স, টেকনিশিয়ান, ডেন্টিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট চিকিৎসকদের বাসস্থান, ছাত্রদের জন্য ডরমিটরি, দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের বাসস্থান নির্মাণ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে থাকাকে নিরাপদ আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। বিনা ভাড়ায় বাসস্থান ইউনিয়ন পর্যায়ে চিকিৎসকদের মাসিক ১০ হাজার টাকা ইউনিয়নে অবস্থান ভাতা দিলে তরুণ চিকিৎসকরা কর্মস্থলে সর্বক্ষণ অবস্থান করতে আগ্রহী হবেন। চিকিৎসকদের পর্যায়ক্রমে ছয় মাস একাধিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে, পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফায়েড বিশেষজ্ঞে উন্নীত করুন এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সর্বক্ষণ সপরিবারে বসবাস সাপেক্ষে মাসে ৫০ হাজার টাকা নন-প্র্যাকটিসিং বিশেষজ্ঞ ভাতার ব্যবস্থা আকর্ষণীয় পদক্ষেপ হবে। উল্লেখ্য, সরকার আমলাদের মাসিক ৫০ হাজার টাকা গাড়ি সংরক্ষণ ভাতা দিয়ে থাকেন।

আগামী ১০ বছরে ইউনিয়নের লোকসংখ্যা বেড়ে ৫০ থেকে ৭০ হাজারে উন্নীত হবে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রাচীর মেরামত, বাসস্থান নির্মাণ, ৩০ শয্যার হাসপাতাল সম্প্রসারিত বহির্বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার পাঁচ শয্যার সিসিইউ বা আইসিইউ, প্রসবরুম, ল্যাবরোটরি, ছাত্রদের ডরমিটরি, লাইব্রেরি ডাইনিং রুমের ব্যবস্থা বাবদ প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট নির্মাণে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হবে। প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক অন্যান্য কর্মীর বাসস্থান নির্মাণে কোটি টাকা ব্যয় হবে।

প্রত্যেক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা থাকতে হবে। রেফার করা প্রত্যেক রোগী ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে উপজেলা জেলা হাসপাতালে যাবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসক কর্মকর্তার মর্যাদা হবে ডেপুটি সিভিল সার্জনের। নবীন চিকিৎসকরা মোটরসাইকেল কেনার জন্য বিনা সুদে ধার পাবেন।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সেবাকে আকর্ষণীয় জনকল্যাণকর করার লক্ষ্যে একটি মোবাইল এক্স-রে, ইসিজি, ইকোগ্রাম, আলট্রাসনোগ্রাম, বায়োকেমিস্ট্রি, রক্ত পরিসঞ্চালন, মাইক্রোবায়োলজি, হেমাটোলজি অ্যানালাইজার, কার্ডিয়াক মনিটর, ডিফিবরিলেটর, ভেন্টিলেটর সজ্জিত প্যাথলজি ল্যাবরেটরিতে ৫০ রকমের পরীক্ষা করা যাবে। ব্যয় হবে মাত্র কোটি টাকা। কমিউনিটি ক্লিনিকে ৮০০ বর্গফুটের একটি প্রসব কক্ষ, একটি প্যাথলজি, রক্ত পরিসঞ্চালন রুম রোগীর বিশ্রাম কক্ষ নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বাবদ ব্যয় হবে ২০ লাখ টাকা মাত্র।

বর্তমান বাজেটে হাজার ৫০০ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রকে, ২০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ যন্ত্রপাতি সজ্জিত করুন। দ্বিতীয় বছরে বাকি সেন্টারগুলো নির্মাণ যন্ত্রপাতির জন্য বরাদ্দ দিন। প্রতি বছর তরুণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিন। সেন্টারগুলো সচল সক্রিয় হবে। তবে সব চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, ডেন্টিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্টদের নিয়োগ হবে জেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে; ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নয়।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ করতে হবে। পাঁচ লাখ চিকিৎসক সৃষ্টির লক্ষ্যে সব মেডিকেল কলেজে প্রতি বছর ২০ হাজার ছাত্র ভর্তির প্রয়োজন রয়েছে। সাশ্রয় উন্নত শিক্ষার জন্য মেডিকেল কলেজের ইউনিট হিসেবে ডেন্টিস্ট্রি ফিজিওথেরাপি পরিচালনা করা যুক্তিসংগত পদক্ষেপ হবে। ছাত্রদের ইউনিয়ন পর্যায়ে রেখে শিক্ষাদান করলে ব্যয় হবে বছরে ২০ কোটি টাকা।

 

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন