অর্থ পাচার ও দুর্নীতি বিষয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিক সরকার

দেশের অর্থনীতির জন্য অন্যতম বড় অশনিসংকেত অর্থ পাচার। আন্তর্জাতিক চার সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জেএফআই), সুইস ব্যাংক, ইউএনডিপি, আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা প্যারাডাইস পেপারসে আমাদের দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষ করে জেএফআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৭০০-৯০০ কোটি ডলার পাচার হয়। ভয়াবহ উদ্বেগজনক তথ্য বৈকি। পাচারকৃত অর্থের মাধ্যমে কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়াসহ কিছু দেশে বাংলাদেশীদের সেকেন্ড হোম গড়ারও খবর মিলছে। এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ পাচার বিষয়ে অনেক দিন ধরে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনা চলছে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়েও আলাপ-সংলাপ হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। অবস্থায় অর্থ পাচার বিষয়ে সংসদে আবারো কঠোর সমালোচনা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা পাচারকারীদের তালিকা প্রকাশ, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং সর্বতোভাবে দুর্নীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি আমলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

সমস্যার ব্যাপকতা প্রকটতা বিবেচনায় সরকারি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন তো নেই-, বরং দেশ থেকে অর্থ পাচার ক্রমে বাড়ছে। মূলত ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে অর্থ। পুঁজি পাচারের পেছনে বেশকিছু কারণ আছে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি প্রভৃতি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এক্ষেত্রে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বেপরোয়া দুর্নীতি। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি ঘোষণা করেছেন। দুর্নীতি নিরুৎসাহিত করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। এর পরেও দুর্নীতি কমছে না। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থই বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে অর্থ পাচারের প্রায় ৯০ শতাংশই দুর্নীতির টাকা বলে উঠে এসেছে। বাকি ১০ শতাংশ পাচার হচ্ছে অন্যান্য কারণে। অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক লুট করে বাইরে পাচার করছেন। আবার অনেকেই পাচার করছেন অন্যায্য মাশুল আদায় ঘুষ-দুর্নীতির অর্থ।

অর্থ পাচার শুধু বাংলাদেশের নয়, উন্নয়নশীল অনেক দেশেরই প্রপঞ্চ। প্রতিবেশী ভারত থেকেও দুর্নীতিজাত  বিপুল অর্থ  পাচার হয়। সমস্যা থেকে উত্তরণে দেশটি বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় কাঠামো চুক্তি। বিশেষ করে সুইস ব্যাংকের সঙ্গে দেশটি চুক্তি করেছে ২০১৬ সালে। এর পর থেকে তারা  তথ্যও পেতে শুরু করেছে। এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সুইস ব্যাংকে কী পরিমাণ অর্থ রেখেছে, তার বিস্তারিত তথ্য পায়। ফলে পাচারকারীদের চিহ্নিত করা এবং ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়। শুধু সুইস ব্যাংক নয়, অন্য দেশের কর অবকাশ কেন্দ্রগুলোয়ও ধরনের চুক্তিতে এগোচ্ছে দেশটি। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারত থেকে অর্থ পাচারের হার অনেকটা কমে এসেছে। শ্রীলংকাও ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এর সুফল পাচ্ছে দেশটি। কমে আসছে অর্থ পাচারের পরিমাণ। বাংলাদেশেরও পাচারের গন্তব্য চিহ্নিত করে বিভিন্ন দেশ বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্যবিনিময় কাঠামো চুক্তি করা প্রয়োজন। মাঝে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে সুইজারল্যান্ডের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) কাছে সে দেশের ব্যাংকগুলোয় রাখা বাংলাদেশীদের অর্থের তথ্য চাওয়ার পাশাপাশি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছিল। অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ওইটুকুই। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থের পাচার ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা কূটনৈতিক তত্পরতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

অর্থ পাচার রোধের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আইন-কানুনের ঘাটতি নেই। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন রয়েছে। দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্যের আদান-প্রদান করতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এগমন্ট গ্রুপের সদস্যও হয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, এনবিআরের সিআইসিসহ বিভিন্ন সংস্থা অর্থ পাচার রোধে কাজ করে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত জনবল, প্রশিক্ষণও আছে তাদের। এর পরও অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না। অর্থনীতিবদরা বলছেন, দেশে দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে বিদেশে অর্থ পাচার রোধ করা যাবে না। মূল বিষয়টি এখানেই নিহিত। এটা গভীরভাবে আমলে নেয়া চাই। শুধু আশ্বাস কিংবা হুঁশিয়ারি নয়, দুর্নীতি বন্ধে দরকার দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ।

একবার অর্থ পাচার হলে তা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। প্রক্রিয়াগত জটিলতা প্রচুর। তাই সর্বাগ্রে কারা পাচার করছে, কীভাবে পাচার করছে তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে হবে। নিয়োজিত সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। অর্থ পাচারের জন্য তুলনামূলকভাবে উন্নত দেশকে বেছে নেয়া হচ্ছে। গন্তব্য দেশগুলো খতিয়ে দেখে অর্থ পাচার রোধে তাদের সঙ্গে বাড়াতে হবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি দেশে তৈরি করতে হবে বিনিয়োগ পরিবেশ। সরকার বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়নে কার্যক্রম জোরদার করতে হবে বৈকি।

অর্থ পাচার বৈশ্বিক প্রবণতা হলেও বাংলাদেশের মতো ভঙ্গুর অর্থনীতির পক্ষে এর দায় বহন করা দুরূহ। কাজেই অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ করার পাশাপাশি অর্থ পাচার বন্ধেও কার্যকর কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন