আলোকপাত

পুঁজি পাচার বন্ধে প্রয়োজন দুর্নীতি দমনে আন্তরিকতা

ড. মইনুল ইসলাম

গত জুন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংসদের বিরোধী দলের সদস্যদের কাছে অর্থমন্ত্রীর একটি অনুরোধ দেখতে পেলাম, কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে এরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন। জুন একটি দৈনিকের সম্পাদকীয়র জবাবে বলছে, চোখ-কান বন্ধ করে কেউ যদি কিছু খুঁজতে চায়, তবে কোনো দিনই তার সন্ধান মিলবে না। অর্থমন্ত্রী যাঁদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁদের নাম-ধাম পেতে হলে শুধু চোখ-কান খুলতে হবে, আর সেই অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে তাঁর সরকারের সদিচ্ছা লাগবে। সম্পাদকীয়র সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও বলি, তালিকা প্রণয়ন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা কেন তাকে নাম দেবেন? হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বহু আগেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর রুল জারি করে পাচারকারীদের নাম জানতে চেয়েছেন। রুল অনুযায়ী দুদকের আইনজীবী দায়সারাভাবে একটি তালিকা বেঞ্চে পেশ করার কারণে মাননীয় বিচারপতিদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। আদালত তাকে ওই তালিকা ফেরত দিয়ে আন্তরিকভাবে তদন্ত করে আরো পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করার রায় ঘোষণা করেছেন। আদালত মন্তব্য করেছেন, পুঁজি পাচারকারীরা জাতির দুশমন। এর কিছুদিন পর গত ১৮ নভেম্বর ঢাকায় মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি স্ব-উদ্যোগে কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া সম্পর্কে একটি গোপন জরিপ চালিয়ে ২৮টি নমুনা থেকে দেখেছেন যে রাজনীতিবিদরা নন, বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। এই ২৮ পরিবারের মধ্যে চারটি পরিবার রাজনীতিবিদদের, বাকিগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের এবং গার্মেন্ট মালিকদের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় থেকে ওই তালিকা সংগ্রহ করা কি অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের জন্য খুব কঠিন? বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিআইডির কাছে পুঁজি পাচারকারীদের নাম-ধাম সরবরাহ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। সাম্প্রতিক সাড়া জাগানো পুঁজি পাচারকারী পি কে হালদারের কাহিনী কিংবা পাপুলের কাহিনী সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী খোঁজখবর নেননি কেন? ২০১৮ সালে পানামা পেপারস প্যারাডাইস পেপারসে ৮২ জন বাংলাদেশী পুঁজি পাচারকারীর নাম প্রকাশিত হয়েছিল, অর্থমন্ত্রীর কাছে তাদের নাম নেই কেন? অর্থমন্ত্রী কি জানেন না, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সমস্যার সঙ্গে পুঁজি পাচার সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত? তিনি অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর একের পর এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে ঋণখেলাপিদের অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চলেছেন এবং খেলাপি ঋণ সংকটকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখছেন। যেখানে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ এরই মধ্যে লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে তিনি সংসদের চলমান বাজেট অধিবেশনেই ঘোষণা দিয়েছেন যে সমস্যাটি গুরুতর নয়! ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, এটা কি তিনি জানেন না? নাকি জানেন কিন্তু মানেন না!!

ঔপনিবেশিক আমলের পুঁজি পাচারকারীদের মতো বাংলাদেশের এই পুঁজি লুটেরা পুঁজি পাচারকারীরা জাতির এক নম্বর দুশমন ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের আগে তদানীন্তন বাংলা ছিল সারা ভারতবর্ষে সবচেয়ে সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতি এবং কুটির শিল্পজাত পণ্য রফতানির বিশ্বখ্যাত অঞ্চল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুঁজি লুণ্ঠন, পুঁজি পাচার এবং ঔপনিবেশিক লুটেরা শাসন-শোষণের শিকার হয়ে পরবর্তী ১০০ বছরে ওই সমৃদ্ধ অর্থনীতি অবিশ্বাস্য বরবাদির অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছিল। মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্রুক এডামস জানাচ্ছেন, ১৭৫৭ সালের পর বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কাঠের জাহাজে পুঁজি পাচার এত বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল যে ওই জাহাজগুলো লন্ডন বন্দরে মাল খালাস করার জন্য প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। এই লুণ্ঠন পর্বকে ইতিহাসবিদরা এখন দ্য বেঙ্গল লুট নামে অভিহিত করেন। বলা হচ্ছে যে ওই লুণ্ঠিত পুঁজি ইংল্যান্ডের প্রথম শিল্প বিপ্লবে তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল। ১৮৫৮ সালে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন চালু হওয়া সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন পুঁজি পাচার থেকে মুক্তি মেলেনি বাংলার। উপরন্তু, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নেমে এসেছিল ১৯৪৭ সালে, যখন পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ প্রভুদের ভারতভাগের শিকার হয়ে আরেকবার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরের ২৪ বছর মেকি স্বাধীনতার আড়ালে আবারো চলেছিল শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি পাচার এবং সীমাহীন বঞ্চনা বৈষম্য। এই ২১৪ বছরের লুণ্ঠন, পুঁজি পাচার শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে রিক্ত-নিঃস্ব হওয়ার কারণেই ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে অভিহিত করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি বর্তমানে এই ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন পুঁজি পাচারকারীরা প্রতি বছর গড়ে ৭০০-৯০০ কোটি ডলার পুঁজি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে বলে নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) গবেষণায় উদ্ঘাটিত হচ্ছে। এর মানে, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাকিস্তানি পুঁজি পাচারকারীদের ভাবশিষ্য এই নব্য পুঁজি পাচারকারীদের বিপুল পুঁজি পাচারের কারণে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছর কম হচ্ছে। যারা এসব পুঁজি পাচারকারীকে জেনে-শুনে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছেন, তারাও কী ভূমিকা পালন করছেন ভেবে দেখবেন। বহুদিন আগে থেকেই আমাদের নীতিপ্রণেতাদের আমি পুঁজি পাচার প্রতিরোধে কঠোর নীতি প্রণয়ন বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ওই আহ্বান বিফলে গেছে।

পুঁজি পাচারের প্রধান মেকানিজমগুলো: বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যবসায়ী-শিল্পপতি পুঁজি পাচারের প্রধান কুশীলব হিসেবে বহুল পরিচিত হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আভাস মিলছে বর্তমানে দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক-সিভিল আমলা-প্রকৌশলী-পেশাজীবীরা প্রধান পুঁজি পাচারকারীর ভূমিকা পালন করছেন। সপরিবার বিদেশে হিজরত করে কোনো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে পরবর্তী সময়ে দিন গুজরানের খায়েশে মত্ত হয়ে এই নব্য পাচারকারীরা এখন অহর্নিশ পুঁজি পাচারে মেতে উঠেছেন। বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং পুঁজি পাচারের সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত পদ্ধতি, আর রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রফতানি আয় জমা না দিয়ে বিদেশে রেখে দেয়া পুঁজি পাচারের সবচেয়ে পপুলার মেথড কিন্তু এই পুরনো পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি এখন প্রবাসী বাংলাদেশীদের বহুল ব্যবহূত হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণের অভ্যাস পুঁজি পাচারকারীদের একটি সহজ বিকল্প উপহার দিয়েছে পলাতক পুঁজির পলায়নকে একেবারে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন সুলভ করে দেয়ার মাধ্যমে। হুন্ডি পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ যেহেতু বিদেশেই থেকে যায়, তাই ঠিক কত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রতি বছর হুন্ডি চক্রে প্রবেশ করছে তার হদিস পাওয়া প্রায় অসম্ভব বলা চলে। কিন্তু এই হুন্ডি ডলারের সমপরিমাণ টাকা রেমিট্যান্স প্রেরকের পরিবারের সদস্য আত্মীয়-স্বজনরা যেহেতু পেয়ে যাচ্ছেন, তাই অর্থ প্রবাসীদের পরিবার স্বজনদের ভোগ এবং বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখছে। ফরমাল চ্যানেল বা ইনফরমাল চ্যানেল, যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক না কেন, তার অর্থনৈতিক সুফল পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে হুন্ডি ডলার বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে, সেগুলো হুন্ডি চক্রগুলোর কাছ থেকে কিনছে দেশে দুর্নীতিজাত কালো টাকার মালিকরা এবং ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার কালচার সৃষ্টিকারী কিছু ব্যবসায়ী। মার্জিনখোর রাজনীতিক বলুন, দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা-প্রকৌশলী বলুন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি বলুন, ডাকসাইটে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বলুনহুন্ডি ডলারের সহায়তায় বিদেশে পুঁজি পাচারে মশগুল হয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। প্রায় সব উন্নত দেশেই ন্যূনতম পরিমাণ পুঁজি নিয়ে গেলে ইমিগ্রেশন প্রদানের নিয়ম চালু রয়েছে। আর এভাবেই ক্রমে গড়ে উঠছে টরন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম। ব্যাংকঋণ পাচারকারী বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পুঁজি পাচারকারীদের সেজন্যই ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন আখ্যায়িত করছি। এত বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না, তার পেছনেও রেমিট্যান্স থেকে উদ্ভূত বিশাল আমানত প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এক অর্থে এই বিপুল অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) একটা তাত্পর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ উল্লম্ফনও ঘটাচ্ছে প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স। বিশেষত করোনা মহামারীর কারণে গত ১৫ মাসে হুন্ডি পদ্ধতি বিপর্যস্ত হওয়ায় দেশের ফরমাল চ্যানেলের রেমিট্যান্সপ্রবাহে যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সতেজ রাখছে। মহামারীর কারণে পুঁজি পাচারও অনেকখানি শ্লথ হয়ে যাওয়ায় বর্তমান অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শন করায় বড় উল্লম্ফন ঘটেছে। মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবারো পুঁজি পাচার পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে। পুঁজি পাচার দমন করতে হলে দুর্নীতি পুঁজি লুণ্ঠনকে সত্যিকার সদিচ্ছা আন্তরিকতার সঙ্গে দমন করতেই হবে। নয়তো শুধু পুঁজি পাচারকারীদের তালিকা পেলেই সরকার পুঁজি পাচার শ্লথ করতে পারবে না।

 

. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ  অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন